পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৬
বাংলা শব্দতত্ত্ব

 এই ‘জাতি’ শব্দের প্রসঙ্গে আর-একটি শব্দ মনে পড়িতেছে যাহার একটা কিনারা করা আশু আবশ্যক। কোনো বিশেষকালে-জাত সমস্ত প্রজাকে ইংরেজিতে generation বলে। বর্তমান অতীত বা ভাবী জেনেরেশন সম্বন্ধে যখন বাংলায় আলোচনার দরকার হয় তখন আমরা পাশ কাটাইয়া যাই। কিন্তু বিঘ্ন দূর না করিয়া বিঘ্ন এড়াইয়া চলিলে ভাষার দুর্বলতা ঘোচ না।

 বস্তুত বাংলায় ‘প্রজা’ কথার অন্য অর্থ যদি চলিত না থাকিত তবে ওই কথাটি ঠিক কাজে লাগিত। বর্তমানে যাহারা জাত তাহাদিগকে বর্তমানকালের প্রজা, অতীতকালে যাহারা জাত তাহাদিগকে অতীত কালের প্রজা বলিলে কোনো গোল হইত না। কিন্তু এখন আর উপায় নাই।

 ‘জন’ কথাটারও ওই রকমেরই অর্থ। জন্ম শব্দের সঙ্গেই উহার যোগ। কিন্তু উহার প্রচলিত অর্থটি প্রবল, অন্য কোনো অর্থে উহাকে খাটানো চলিবে না।

 অতএব প্রজা এবং জন এই কথার মাঝামাঝি একটা কথা যদি পাওয়া যায় তাহা হইলে সেটা ব্যবহারে লাগানো যায়। যথা প্রজন। মনুতে স্ত্রীলোকের বর্ণনাস্থলে আছে ‘প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হ গৃহদীপ্তয়ঃ। অর্থাৎ প্রজনের জন্য স্ত্রীজাতি পুজনীয়া। ইংরেজি ভাষায় generation শব্দের অন্য যে-অর্থ আছে অর্থাৎ জন্মদান করা, এই প্রজনের সেই অর্থ। কিন্তু পূর্বকথিত অর্থে এই শব্দ ব্যবহার করিলে কানে খারাপ লাগিবে না। প্রজন শব্দটা প্রথমে বুঝিতে হয়তো গোল ঠেকিবে, উহার বদলে যদি ‘প্রজাত’ শব্দ ব্যবহার করা হয় তাহা হইলে অপেক্ষাকৃত সহজে বুঝা যাইবে। এ সম্বন্ধে পাঠকদের মত জানিতে চাই।

 আমার ‘প্রতিশব্দ’ প্রবন্ধ উপলক্ষে একটিমাত্র বিতর্ক উঠিয়াছে। সেটা ‘মৌলীন্য’ কথা লইয়া। Originality শব্দের যে প্রতিশব্দ আজকাল চলিতেছে সেটা ‘মৌলিকতা’। সেটা কিছুতেই আমার ভালো লাগে নাই। কারণ ‘মৌলিক’ বলিলে সাধারণত বুঝায় মূলসম্বন্ধীয়— ইংরেজিতে radical বলিতে যাহা বুঝায়। যথা, radical change—মৌলিক পরিবর্তন। আপনাতেই যাহার মুল, তাহাকে মৌলিক বলিলে কেমন বেখাপ শোনায়। বরং নিজমূলক বলিলে চলে। কখনো কখনো আমি ‘স্বকীয়তা’ শব্দ Originality অর্থে ব্যবহার করিয়াছি। কিন্তু সর্বত্র ইহা খাটে না। বিশেষ কাব্যকে স্বকীয় কাব্য