পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভাষার খেয়াল
২৪৫

 ভাবপ্রকাশের কাজে শব্দের ব্যবহার সম্বন্ধে কাব্যের বােধশক্তি গদ্যের চেয়ে সূক্ষ্মতর এ কথা মানতে হবে। লক্ষ্যিয়া, সন্ধিয়া, বন্দিনু, স্পর্শিল, হর্ষিল শব্দগুলাে বাংলা কবিতায় অসংকোচে চালানাে হয়েছে। এ সম্বন্ধে এমন নালিশ চলবে না যে ওগুলাে কৃত্রিম, যেহেতু চলতি ভাষায় ওদের ব্যবহার নেই। আসল কথা, ওদের ব্যবহার থাকাই উচিত ছিল; বাংলা কাব্যের মুখ দিয়ে বাংলা ভাষা এই ত্রুটি কবুল করেছে। (‘কব্‌লেছে’ প্রয়ােগ বাংলায় চলে কিন্তু অনভ্যস্ত কলমে বেধে গেল!) ‘দর্শন লাগি ক্ষুধিল আমার আঁখি’ বা ‘তিয়াষিল মাের প্রাণ’— কাব্যে শুনলে রসজ্ঞ পাঠক বাহবা দিতে পারে, কেননা, ক্ষুধাতৃষ্ণাবাচক ক্রিয়াপদ বাংলায় থাকা অত্যন্তই উচিত ছিল, তারই অভাব মােচনের সুখ পাওয়া গেল। কিন্তু গদ্য ব্যবহারে যদি বলি যতই বেলা যাচ্ছে ততই ক্ষুধােচ্চি অথবা তেষ্টাচ্চি তা হলে শ্রোতা কোনাে অনিষ্ট যদি না করে অন্তত এটাকে প্রশংসনীয় বলবে না।

 বিশেষ্য-জোড়া ক্রিয়াপদের জোড় মিলিয়ে এক করার কাজে মাইকেল ছিলেন দুঃসাহসিক। কবির অধিকারকে তিনি প্রশস্ত রেখেছেন, ভাষার সংকীর্ণ দেউড়ির পাহারা তিনি কেয়ার করেন নি। এ নিয়ে তখনকার ব্যঙ্গ রসিকেরা বিস্তর হেসেছিল। কিন্তু ঠেলা মেরে দরজা তিনি অনেকখানি ফাঁক ক’রে দিয়েছেন। ‘অপেক্ষা করিতেছে’ না ব’লে ‘অপেক্ষিছে’, ‘প্রকাশ করিলাম’ না বলে ‘প্রকাশিলাম’ বা ‘উদ্‌ঘাটন করিল’-র জায়গায় ‘উদ্‌ঘাটিল’ বলতে কোনাে কবি আজ প্রমাদ গণে না। কিন্তু গদ্যটা যেহেতু চলতি কথার বাহন ওর ডিমক্রাটিক বেড়া অল্প একটু ফাঁক করাও কঠিন। ‘ত্রাস’ শব্দটাকে ‘ত্রাসিল’ ক্রিয়ার রূপ দিতে কোনাে কবির দ্বিধা নেই কিন্তু ‘ভয়’ শব্দটাকে ‘ভয়িল’ করতে ভয় পায় না এমন কবি আজও দেখি নি। তার কারণ ত্রাস শব্দটা চলতি ভাষার সামগ্রী নয়, এইজন্যে ওর সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অসামাজিকতা ডিমক্রাসিও খাতির করে। কিন্তু ‘ভয়’ কথাটা সংস্কৃত হলেও প্রাকৃত বাংলা ওকে দখল করে বসেছে। এইজন্যে ভয় সম্বন্ধে যে প্রত্যয়টার ব্যবহার বাংলায় নেই তার দরজা বন্ধ। কোন্ এক সময়ে ‘জিতিল’ ‘হাঁকিল’ ‘বাঁকিল’ শব্দ চলে গেছে, ‘ভয়িল’ চলে নি— এ ছাড়া আর কোনাে কৈফিয়ৎ নেই।

 বাংলা ভাষা একান্ত আচারনিষ্ঠ। সংস্কৃত বা ইংরেজি ভাষায় প্রত্যয়গুলিতে নিয়মই প্রধান, ব্যতিক্রম অল্প। বাংলা ভাষার প্রত্যয়ে আচারই প্রধান; নিয়ম