পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৫২
বাংলা শব্দতত্ত্ব

নাই। সেই শিক্ষিত ব্যক্তির পনেরো-আনা যদি বাংলা লিখিতে না পায় তবে সম্ভবত ভাষা অত্যন্ত বিশুদ্ধ হইবে কিন্তু সে ভাষার প্রয়োজন থাকিবে না।

 আধুনিক বাংলা সাহিত্যটাকে গড়িয়া তুলিতেছেন যাঁহারা, তাঁহারা ইংরেজিনবিশ। তাঁহাদের পেটে কথা জমিয়াছে বলিয়াই তাঁহারা লিখিয়াছেন। যাঁহারা সংস্কৃত ব্যাকরণে পণ্ডিত তাঁহারা বাংলা ভাষার প্রতি মন দেন নাই সে তো জানা কথা। এখনো বাংলা যাঁহারা লেখেন তাঁহাদের অতি অল্প সংখ্যাই সংস্কৃত ভালো করিয়া জানেন।··· যাঁহারা ইংরাজি জানেন না কেবল মাত্র সংস্কৃত জানেন তাঁহারা কেহ কেহ বাংলা লেখেন, তাহার ভাষা বিশুদ্ধ কিন্তু বাজারে তাহা চলে। অনেক লেখক লিখিতে লিখিতে ক্রমে সংস্কৃত শিখিতে থাকেন— কালীপ্রসন্ন ঘোষ মহাশয় যখন প্রথম লিখিতে আরম্ভ করেন তখন তিনি সংস্কৃতে পাকা ছিলেন না, তাঁহার লেখায় তাহার প্রমাণ আছে কাজেই সাহিত্যে এমন অনেক জিনিস জমিয়া উঠিতে থাকে— ব্যাকরণের সূত্র যাহার মধ্যে প্রবেশ করিবার পথ পায় না।

 বাংলা লেখকের পুরস্কার যে খুব বেশি তাহা নয়, ইহার উপরে তাহার লেখনী চালনার পথ যদি অত্যন্ত দুর্গম করা হয় তবে সীতা পাইবার আশা পরিত্যাগ করিয়াও লোককে ধনুক ভাঙিতে ডাকা হয়। তাই বলিয়াই যে ভাষার উপরে যে যেমন খুশি দৌরাত্ম্য করিবে তাহাও সহ্য করা যায় না। অতএব একটা রফা নিষ্পত্তির পথ ধরিতেই হয়। কিন্তু সে পথটা কেহ বাঁধিয়া দিতে পারে না— নদীর মতো ভাষা আপনিই স্বল্পতম বাধার পথ হাতড়াইয়া চলে। আপনি সে কথাও বলিয়াছেন। আপনার বই পড়িয়াই আমার মনে বিশেষ করিয়া এই চিন্তার উদয় হইল— বাংলা সাহিত্যের খেয়া পার হইতে হইলে তিন ঘাটে তাহার মাশুল দিতে হয়, বাংলা ইংরেজি এবং সংস্কৃত। বাংলা ও ইংরেজির পারানির কড়ি কোনো প্রকারে সংগ্রহ হয়, সংস্কৃতের বেলায় ঠেকে, কেননা তাহার জন্য দূরে ঘোরাঘুরি করিতে হয়— সকলের সামর্থ্যে ও সময়ে কুলায় না— এইজন্য সংস্কৃতের কুতঘাটায় যাহারা ফাঁকি দেয় তাহাদের প্রতি দণ্ডবিধি কঠোর করিলে খেয়া একেবারে বন্ধ করিতে হয়। এটা আমি নিজের প্রাণের ভয়ে বলিলাম বটে কিন্তু সাহিত্যের প্রতি মমতা রাখি বলিয়াও বলিতে হইল। চিঠিখানা বড়ো হইয়া গেল সুতরাং ইহার মধ্যে পাণিনি-পীড়ন নিশ্চয়ই ঘটিয়াছে— আর অপরাধ বাড়াইবার স্থান নাই অতএব যদি ক্ষমা করেন, তবে বিলাতি কায়দায়