পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৫৮
বাংলা শব্দতত্ত্ব

এই গেল ছন্দব্যবসায়ী কবির কৈফিয়ত।

 কিন্তু শুধু কেবল কাব্যক্ষেত্রে ডিক্রি পাইয়াই আমি সন্তুষ্ট থাকিব না, আমার আরো কিছু বলিবার আছে। বীরেশ্বরবাবুর মতে মূল শব্দের সহিত তদ্ভব শব্দের বানানের সাদৃশ্য থাকা উচিত। যদি তাঁর কথা মানিতে হয় তবে বাংলার বানান-মহালে হুলস্থূল পড়িয়া যায়। এই আইন অনুসারে কিরূপ পরিবর্তন হয় তার গোটাকতক নমুনা দেখা যাক। শাঁখ-শাঙ্খ্। আঁক—আঙ্ক্। চাঁদ —চাঁন্দ্। রাখ―রাক্ষ। আমি-আহ্‌মি।

 হয়তো বীরেশ্বরবাবু বলিবেন, হাঁ এইরূপ হওয়াই উচিত। তাঁর পক্ষে ভালো নজিরও আছে। ইংরেজিতে বানানে-উচ্চারণে ভাসুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্ক, পরস্পরের মাঝখানে প্রাচীন শব্দতত্ত্বের লম্বা ঘোমটা। ইংরেজিতে লিখি ট্রেআসূরে (treasure) পড়ি ট্রেজার; লিখি ক্‌নৌলেডগে (knowledge) পড়ি নলেজ্‌; লিখি রিঘ্‌টেওউস (righteous) পড়ি রাইটিয়স। অতএব যদি লিখি পক্ষী অথচ পড়ি পাখী, লিখি বিদ্যুলি পড়ি বিজুলি, লিখি শ্রবণিয়াছিলাম পড়ি শুনিয়াছিলাম, বিলাতিমতে তাহাতে দোষ হয় না।

 কিন্তু আমাদের দেশের নজির উল্‌টা। প্রাকৃত ও পালি, বানানের দ্বারা নির্ভয়ে নিজের শব্দেরই পরিচয় দিয়াছে, পূর্বপুরুষের শব্দতত্ত্বের নহে। কেননা, বানানটা ব্যবহারের জিনিস, শব্দতত্ত্বের নয়। পুরাতত্ত্বের বোঝা মিউজিয়ম বহন করিতে পারে, হাটে বাজারে তাহাকে যথাসাধ্য বর্জন করিতে হয়। এইজন্যই লিখিবার বেলায় আমরা ‘নুন’ লিখি, পণ্ডিতই জানেন উহার মূল শব্দে একটা মূর্ধণ ণ ছিল। এইজন্যই লিখিবার বেলা গাম্ভ্‌লা না লিখিয়া আমরা গাম্‌লা লিখি, পণ্ডিতই অনুমান করেন উহার মূল শব্দ ছিল কুম্ভ। আমরা লিখিয়া থাকি আঁতুর ঘর, তাহাতে আমাদের কাজের কোন ক্ষতি হয় না— পাণ্ডিত্যের দোহাই মানিয়া যদি অন্ত্র-ত্রুট্ ঘর বানান করিয়া আঁতুর ঘর পড়িতে হইত তবে যে-শব্দ প্রাচীনের গর্ভ হইতে বাহির হইয়াছে তাহাকে পুনশ্চ গর্ভবেদনা সহিতে হইত।

 প্রাচীন বাঙালি, বানান সম্বন্ধে নির্ভীক ছিলেন, পুরানো বাংলা পুথি দেখিলেই তাহা বুঝা যায়। আমরা হঠাৎ ভাষার উপর পুরাতত্ত্বের শাসন চালাইবার জন্য ব্যপ্ত হইয়াছি। এই শাসন ম্যালেরিয়া প্রভৃতি অন্যান্য নানা উপসর্গের মতো চিরদিনের মতো বাঙালির ছেলের আয়ুক্ষয় করিতে থাকিবে। কোনো অভ্যাসকে একবার পুরানো হইতে দিলেই তাহা স্বভাবের চেয়েও প্রবল হইয়া ওঠে। অতএব