পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা

মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা ভাষা

বৈশাখের [১৩৩৯] প্রবাসীতে মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা ভাষা প্রবন্ধটি পড়ে দেখলুম। আমি মূল পুস্তক পড়ি নি, ধরে নিচ্ছি প্রবন্ধ-লেখক যথোচিত প্রমাণের উপর নির্ভর করেই লিখেছেন। সাম্প্রদায়িক বিবাদে মানুষ যে কতদুর ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে ভারতবর্ষে আজকাল প্রতিদিনই তার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই, কিন্তু হাস্যকর হওয়াও যে অসম্ভব নয় তার দৃষ্টান্ত এই দেখা গেল। এটাও ভাবনার কথা হতে পারত, কিন্তু সুবিধা এই যে এরকম প্রহসন নিজেকেই নিজে বিদ্রূপ করে মারে।

 ভাষা মাত্রের মধ্যে একটা প্রাণধর্ম আছে। তার সেই প্রাণের নিয়ম রক্ষা করে তবেই লেখকেরা তাকে নূতন নূতন পথে চালিত করতে পারে। এ কথা মনে করলে চলবে না যে, যেমন করে হোক জোড়াতাড়া দিয়ে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বদল করা চলে। মনে করা যাক, বাংলা দেশটা মগের মুল্লুক এবং মগ রাজারা বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের নাক-চোখের চেহারা কোনোমতে সহ্য করতে পারছে না, মনে করছে ওটাতে তাদের অমর্যাদা, তা হলে তাদের বাদশাহী বুদ্ধির কাছে একটিমাত্র অপেক্ষাকৃত সম্ভবপর পন্থা থাকতে পারে সে হচ্ছে মগ ছাড়া আর-সব জাতকে একেবারে লোপ করে দেওয়া। নতুবা বাঙালিকে বাঙালি রেখে তার নাক মুখ চোখে ছুঁচ সুতো ও শিরীষ আঠার যোগে মগের চেহারা আরোপ করবার চেষ্টা ঘোরতর দুর্দাম মগের বিচারেও সম্ভবপর বলে ঠেকতে পারে না।

 এমন কোনো সভ্য ভাষা নেই যে নানা জাতির সঙ্গে নানা ব্যবহারের ফলে বিদেশী শব্দ কিছু-না-কিছু আত্মসাৎ করে নি। বহুকাল মুসলমানের সংস্রবে থাকাতে বাংলা ভাষাও অনেক পারসী শব্দ এবং কিছু কিছু আরবীও স্বভাবতই গ্রহণ করেছে। বস্তুত বাংলা ভাষা যে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই আপন তার স্বাভাবিক প্রমাণ ভাষার মধ্যে প্রচুর রয়েছে। যত বড়ো নিষ্ঠাবান হিন্দুই হোক-না কেন ঘোতর রাগারাগির দিনেও প্রতিদিনের ব্যবহারে রাশি রাশি তৎসম ও তদ্ভব মুসলমানী শব্দ উচ্চারণ করতে তাদের কোনো সংকোচ বোধ হয়। এমন-কি, সে-সকল শব্দের জায়গায় যদি সংস্কৃত প্রতিশব্দ চালানো যায় তা হলে পণ্ডিতী করা হচ্ছে বলে লোকে হাসবে। বাজারে এসে সহস্র টাকার নোট ভাঙানোর চেয়ে হাজার টাকার নোট ভাঙানো সহজ। সমনজারি শব্দের অর্ধেক অংশ ইংরেজি, অর্ধেক পারসী, এর জায়গায় ‘আহ্বান প্রচার’