পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২৮
বাংলা শব্দতত্ত্ব

না। কবিদিগের কাব্য যিনি সংগ্রহ করেন, তাঁহার সংগ্রহের মধ্যে যদি অসাবধানতা, অবহেলা, অমনোযোগ লক্ষিত হয়, তবে তাঁহার বিরুদ্ধে আমরা অত্যন্ত গুরুতর তিনটি নালিশ আনিতে পারি― প্রথমত, কবিদের প্রতি তিনি অন্যায় ব্যবহার করিয়াছেন; দ্বিতীয়ত, সাহিত্যের সহিত তিনি যে চুক্তি করিয়াছিলেন, সে চুক্তি রীতিমত পালন করেন নাই; তৃতীয়ত, পাঠকসাধারণকে তিনি অপমান করিয়াছেন। তিনি তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়াছেন, অথচ যথাযোগ্য আয়োজন করেন নাই; যথারীতি সম্ভাষণ করেন নাই; এতই কি তাহারা উপেক্ষার পাত্র? “অক্ষরের ভুল হইল হইলই, তাহাতে এমনি কী আসে যায়? অর্থবোধ হইতেছে না? একটা আন্দাজ করিয়া দেও না, কে অনুসন্ধান করিয়া দেখে?” পাঠকদের প্রতি এরূপ ব্যবহার কি সাহিত্যআচারের বিরুদ্ধ নহে?

 শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার বিদ্যাপতি-রচিত পদাবলী পুস্তকাকারে সংগ্রহ করিয়াছেন, অপ্রচলিত শব্দের ও দুরূহ শ্লোকের অর্থ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আমাদের সাহিত্যে এরূপ উদ্যোগ সম্প্রতি আরম্ভ হইয়াছে; অতএব এই উদ্যোগীদের আমরা নিরুৎসাহ করিতে চাহি না; ইহাদের চেষ্টা সর্বতোভাবে প্রশংসনীয়। কেবল আমরা যথাসময়ে ইহাদের সাবধান করিয়া দিতে চাই। আধুনিক বঙ্গীয় পাঠকগণকে নিশ্চেষ্ট জানিয়া ইঁহারা যেন নিজ কাজে শৈথিল্য না করেন। ইঁহাদের পরিশ্রম ও উদ্যমের পুরস্কার হাতে হাতে যদি-বা না পান বঙ্গ-সাহিত্যকে ইঁহারা ঋণী করিয়া রাখিবেন, ও একদিন-না-একদিন সে ঋণ পরিশোধ হইবেই।

 “যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি, কোহত্র দোষ” সে কথা সত্য বটে; কিন্তু আমাদের আলোচ্য পুস্তকের সম্পাদক নিরলস হইয়া যথাসাধ্য যত্ন করিয়াছেন কি না আমাদের সন্দেহ। রসেটি শেলীর কবিতাসমূহের যে সংস্করণ মুদ্রিত করিয়াছেন, তাহাতে তিনি প্রতি কমা ও সেমিকোলনের উপর মাথা ঘুরাইয়াছেন; ইহাতে কবির প্রতি তাঁহার অসাধারণ অনুরাগ ও সাধারণের সমীপে তাঁহার কর্তব্য পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা প্রকাশ পাইতেছে। কিন্তু এরূপ তুলনা বৃথা। কোনো বিষয়েই যাহাদের সহিত মিলে না, একটা বিশেষ বিষয়ে তাহাদের সহিত তুলনা দিতে যাওয়ার অর্থ নাই। বঙ্গদেশ ইংলণ্ড নহে, এবং সকল লোকই রসেটি নহে।