পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৬১
শব্দ-চয়নঃ ১

বাংলা ভাষায় গদ্য লিখতে নতুন শব্দের প্রয়ােজন প্রতিদিনই ঘটে। অনেক দিন ধরে অনেক রকম লেখা লিখে এসেছি সেই উপলক্ষে অনেক শব্দ আমাকে বানাতে হল। কিন্তু প্রায়ই মনের ভিতরে খটকা থেকে যায়। সুবিধা এই যে বারবার ব্যবহারের দ্বারাই শব্দবিশেষের অর্থ আপনি পাকা হয়ে উঠে, মূলে যেটা অসংগত, অভ্যাসে সেটা সংগতি লাভ করে। তৎসত্ত্বে সাহিত্যের গােলে এমন অনেক শব্দের আমদানি হয়, যা ভাষাকে যেন চিরদিনই পীড়া দিতে থাকে। যেমন ‘সহানুভূতি’। এটা sympathy শব্দের তর্জমা। ‘সিম্প্যাথি’-র গােড়াকার অর্থ ছিল দরদ। ওটা ভাবের আমলের কথা, বুদ্ধির আমলের নয়। কিন্তু ব্যবহারকালে ইংরেজিতে ‘সিম্প্যাথি’-র মূল অর্থ আপন ধাতুগত সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই কোনাে একটা প্রস্তাব সম্বন্ধেও সিম্প্যাথি-র কথা শােনা যায়। বাংলাতেও আমরা বলতে আরম্ভ করেছি ‘এই প্রস্তাবে আমার সহানুভূতি আছে’। বলা উচিত ‘সম্মতি আছে’ বা ‘আমি এর সমর্থন করি’। যা-ই হােক্– সহানুভূতি কথাটা যে বানানাে কথা এবং ওটা এখনাে মানান-সই হয় নি তা বেশ বােঝা যায় যখন ও শব্দটাকে বিশেষণ করবার চেষ্টা করি। ‘সিম্প্যাথেটিক’-এর কী তর্জমা হতে পারে, ‘সহানুভৌতিক’, বা ‘সহানুভূতিশীল’ বা ‘সহানুভূতিমান’ ভাষায় যেন খাপ খায় না– সেইজন্যেই আজ পর্যন্ত বাঙালি লেখক এর প্রয়ােজনটাকেই এড়িয়ে গেছে। দরদের বেলায় ‘দরদী’ ব্যবহার করি, কিন্তু সহানুভূতির বেলায় লজ্জায় চুপ ক‘রে যাই। অথচ সংস্কৃত ভাষায় এমন একটি শব্দ আছে, যেটা একেবারেই তথার্থক। সে হচ্ছে ‘অনুকম্পা’। ধ্বনিবিজ্ঞানে ধ্বনি ও বাদ্যযন্ত্রের তারের মধ্যে সিম্প্যাথি-র কথা শােনা যায়– যে সুরে বিশেষ কোনাে তার বাঁধা, সেই সুর শব্দিত হলে সেই তারটি অকম্পিত ও অনুধ্বনিত হয়। এই তো ‘অনুকম্পন’। অন্যের বেদনায় যখন আমার চিত্ত ব্যথিত হয়, তখন সেই তো ঠিক ‘অনুকম্পা’। ‘অনুকম্পায়ী’ কথাটা সংস্কৃতে আছে। ‘অনুকম্পপ্রবণ’ শব্দটাও মন্দ শােনায় না। ‘অনুকম্পালু’ বােধ করি ভালােই চলে। মুশকিল এই যে, দখলের দলিলটাই ভাষায় স্বত্বের দলিল হয়ে ওঠে। কেবলমাত্র এই কারণেই ‘কান, সােনা, চুন, পান’ শব্দগুলােতে মূর্ধন্য ণ-য়ের