পাতা:বাংলা শব্দতত্ত্ব - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৫১

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৩২
বাংলা শব্দতত্ত্ব

  সম্পূর্ণ নিঃসংশয়ের কথা নহে। কারণ, দীনেশবাবু কেবল অকারী পদের দৃষ্টান্ত দিয়াছেন। ইকার-উকারান্ত পদের সহিত আদি শব্দের যোগ তিনি প্রাচীন বাংলা গ্রন্থ হইতে সংগ্রহ করিতে পারেন কি না সন্দেহ। এবং রামাদিগ হইতে রামদিগ হওয়া যত সহজ, কপ্যাদিগ হইতে কপিদিগ এবং ধেন্বাদিগ হইতে ধেনুদিগ হওয়া তত সহজ নহে।

  হিন্দিভাষার সহিত তুলনা করিয়া দেখা আবশ্যক। সাধু হিন্দি—ঘোড়োঁঁকা, কনৌজি—ঘোড়নকো, ব্রজভাষা—ঘোড়ৌঁঁকো অথবা ঘোড়নিকৌ, মাড়োয়ারি—ঘোড়াঁঁরো, মেৱারি—ঘোড়াঁঁকো, গঢ়ৱালি—ঘোড়োঁঁকো, অৱধি—ঘোড়ৱন-কর, রিৱাই—ঘ্বাঁঁড়নকর, ভোজপুরি—ঘোড়নকি, মাগধী—ঘোড়নকের, মৈথিলী—ঘোড়নিক ঘোড়নিকর।

  উদ্‌ধৃত দৃষ্টান্তগুলিতে দেখা যাইতেছে, কা কো কের কর প্রভৃতি ষষ্ঠী বিভক্তি চিহ্নের বহুবচন নাই। বহুবচনের চিহ্ন মূল শব্দের সহিত সানুনাসিক-রূপে যুক্ত।

  অপভ্রংশ প্রাকৃতে ষষ্ঠীর বহুবচনে হং হুং হিং বিভক্তি হয়। সংস্কৃত নারাণাং কৃতকঃ শব্দ অপভ্রংশ প্রাকৃতে নরহং কেরও এবং হিন্দিতে নরোঁঁকো হয়। সংস্কৃত ষষ্ঠী বহুবচনের আনাং হিন্দিতে বিচিত্র সানুনাসিকে পরিণত হইয়াছে।

  বাংলায় এ-নিয়মের ব্যত্যয় হইবার কারণ পাওয়া যায় না। আমাদের মতে সম্পূর্ণ ব্যত্যয় হয় নাই। নিম্নে তাহার আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া গেল। হিন্দিতে কর্তৃকারকে একবচন বহুবচনের ভেদচিহ্ন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। বিশেষ রূপে বহুবচন বুঝাইতে হইলে লোগ্‌গণ প্রভৃতি শব্দ অনুযোজন করা হয়।

  প্রাচীন বাংলারও এই দশা ছিল, পুরাতন কাব্যে তাহার প্রমাণ আছে; দেখা গিয়াছে, সব সকল প্রভৃতি শব্দের অনুযোজনদ্বারা বহুবচন নিপন্ন হইত।

  কিন্তু হিন্দিতে দ্বিতীয়া তৃতীয়া প্রভৃতি বিভক্তির চিহ্ন যোগের সময় শব্দের একবচন ও বহুবচন রূপ লক্ষিত হয়; যথা, ঘোড়েকো— একটি ঘোড়াকে, ঘোড়োঁঁকো— অনেক ঘোড়াকে। ঘোড়ে একবচনরূপ এবং ঘোড়োঁঁ বহুবচনরূপ।

  পূর্বে একস্থলে উল্লেখ করিয়াছি যে, প্রাকৃত একবচন যষ্ঠী বিভক্তিচিহ্ন হে হি স্থলে বাংলায় একার দেখা যায়; যথা অপভ্রংশ প্রাকৃত—ঘরহে, বাংলায় ঘরে।

  হিন্দিতেও এইরূপ ঘটে। ঘোড়ে শব্দ তাহার দৃষ্টান্ত।