পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কতটা নিরেট ভাবে একবাচনিক করে তুলেছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী। ১৯১৭ সালে শুরু হয়েছিল চির-উপেক্ষিত অন্তেবাসী জনের ক্রমিক ঊর্ধ্বায়ন। কার্নিভাল এই দুরূহ প্রক্রিয়ার ইতিহাস-নির্দিষ্ট তত্ত্ববীজ: এই সত্য অস্বীকার করার অর্থ হলো বিপ্লব-পূর্ববর্তী আধিপত্যবাদী শক্তির সমর্থন-যোগানো যুক্তিশৃঙ্খলা তৈরি করা।

 রাবেলেকে উপলক্ষ করে পরিবর্তনের ভাবাদর্শ ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রতি বাখতিন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই সূত্রে পাঠকৃতি আর বাচনও যে বিশেষ মনোযোগের আকর, তা তাঁর বয়ান থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বস্তুত রাবেলে-পাঠে কার্নিভাল ও উদ্ভট বাস্তবতাবাদ দুটি গৌণ পাঠ হিসেবে গণ্য। কার্নিভাল হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও শেষোক্তটি হলো সাহিত্যিক প্রকরণ। প্রতিবেদনে সামাজিক ও সাহিত্যিক নিষ্কর্ষ ও উপাদান কীভাবে মিথষ্ক্রিয়ার আকর, বাখতিন তা দেখিয়েছেন। সেই সঙ্গে সামূহিক ভূমিকায় নিষ্পন্ন লোকায়ত জীবন-চর্যা ও সক্রিয়তা এবং শারীরিক প্রকরণগুলির অর্থবহত্বও বিশ্লেষণ করেছেন। উচ্চ সংস্কৃতি ও নিম্ন সংস্কৃতির চিরাগত ব্যবধানকে সরকারি ও বেসরকারি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বয়ানের সূত্রে ব্যাখ্যা করে প্রতাপের পীড়ন ও অবদমনকে তিনি বাচনের সোচ্চার ও নিরুচ্চার, উদ্ভাসিত ও নিরালোক পরিসরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিয়েছেন। কর্তৃত্ববাদের দ্বারা অনুমোদিত ভাষা, সত্য, নৈতিকতা ও উপস্থাপনা যদিও ধারাবাহিক ভাবে ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, বাখতিন দেখিয়েছেন কীভাবে প্রতিটি স্তরে প্রচ্ছন্ন থাকে কর্তৃত্ববাদের প্রতিস্পর্ধী হাসি ও কৌতুক—‘A boundless world of humourous forms’ (১৯৮৪: ১১)। একমাত্রিক, একরৈখিক ও একবাচনিক রুদ্ধ জগতের সর্বাত্মক আরোপের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন প্রতিবাদ মূলত প্রান্তিক সমাজ থেকেই উঠে আসে। এটাই মানুষের ইতিহাস, তার সংস্কৃতির ইতিহাস।

 বাখতিন জানিয়েছেন: ‘every age has its own norms of official speech and propriety. And every age has its own type of words and expressions that are given as a signal to speak freely, to call things by their own means, without any mental restrictions and euphemism.’ (তদেব: ১৮৮)। এমন মনে করার কোনো কারণ নেই যে বাখতিন রাবেলেকে উপলক্ষ করে মূলত সমসাময়িক রাশিয়া সম্পর্কে এই কথাগুলি বলেছিলেন। হোমার-ভার্জিল-দান্তে-শেক্সপীয়র-গ্যয়ঠে এবং এঁদের মতো অন্য সব কালোত্তর স্রষ্টার সমকালে সরকারি বয়ান ও বিধিবিন্যাস অবশ্যই প্রকট ছিল। কিন্তু প্রতিভার অর্থই হলো সমস্ত রুদ্ধ পরিসরের বিনির্মাণ করে মুক্ত বাচনের প্রতীতিতে পৌঁছানোর ক্ষমতা। এঁদের প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনো ভাবে সমকালীন জনসমাজের সামূহিক বাচন থেকে সৃষ্টির উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা, সমান্তরালভাবে উপস্থিত অপর পরিসরের উপকরণ দিয়ে তাঁরা প্রচলিত সরকারি বয়ানের রুদ্ধতাকে প্রতিহতও করেছেন। নইলে চিন্তা ও অনুভূতির নবীন স্থাপত্য গড়ে উঠতে পারত না।

 ১৯১৭-এর পূর্ববর্তী রাশিয়ার সাহিত্যে পুশকিন-টলস্টয়-ডস্টয়েভস্কি-গোগোল-টুর্গেনিভ প্রমুখ স্রষ্টা জারতন্ত্রের সরকারি বয়ানকে প্রতিহত করেই নিজেদের স্বতন্ত্র অভিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় গোর্কি কি তখনকার সরকারি বয়ানকে অন্ধভাবে অনুগত্য দেখিয়ে গেছেন? আধিপত্যবাদের কাছে সমর্পিত সাহিত্য-

৯৮