পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

বাখতিন, এসময়ে

বহু শতাব্দী ধরে যিনি মানুষের চিন্তাবিশ্বকে আলোকিত করবেন, তাঁর চূড়ান্ত-বিন্দুহীন যাত্রায় এক শতাব্দী মাত্র পূর্ণ হলো চোদ্দ বছর আগে। প্রতীচ্যের তত্ত্বভাবনা, বিশেষত উপন্যাস-চিন্তা, গত তিন দশকে নিরবচ্ছিন্ন উন্মোচনের সূত্রে কেবলই ভাবনার নতুন নতুন অণুবিশ্ব নির্মাণ করে চলেছে। আমাদের পাঠাভ্যাস ও চিন্তাপদ্ধতির সংস্কার এত দৃঢ়প্রোথিত যে একে ধারণ করার মতো ক্ষমতা অর্জন করতে হলে চাই আত্মবিনির্মাণের স্পৃহা। কিন্তু হায়, আমাদের বৌদ্ধিকতার অহংকার এবং নিজস্ব অবস্থানের অনমনীয়তা বাস্তিল দুর্গের চেয়েও বেশি দুর্ভেদ্য। তার ওপর সাম্প্রতিক কালে বিশ্বাসহীনতার চোরাবালি এত সর্বগ্রাসী যে ইতিহাস-ভাবাদর্শ-তাৎপর্য প্রভৃতিও প্রয়োগ-শূন্য তত্ত্ববীজ হিসেবে ধিক্কৃত ও প্রত্যাখ্যাত। ইদানীং বিকেন্দ্রায়নের নামে চরম নৈরাজ্য আমাদের এত বেশি অধিকার করে রেখেছে যে কোনো প্রতিবেদনের স্বত-উৎসারিত যুক্তি-শৃঙ্খলায় আমরা কিছুতেই আস্থা রাখতে পারি না। নিজেদের অবিশ্বাস-দীর্ণ অস্তিত্ব থেকে সংক্রামিত নিরলম্বতার পাণ্ডুরোগ মহামারীর মতো ছড়িয়ে দিচ্ছি চিন্তাবিশ্বের নানা অভিব্যক্তিতে। বিশেষত আধুনিকোত্তরবাদের জটিল সন্দর্ভগুলির আংশিক ও অযথার্থ গ্রহণ কেবলই বিড়ম্বিত করছে আমাদের। তাই বাখতিনের অনন্যতাকে ঈপ্সিত মাত্রায় উপলব্ধি করতে পারছি না সম্ভবত। চিন্তার ইতিহাসের ওপর যেহেতু নিজেদের পূর্বনির্ধারিত কেন্দ্রচ্যুত অবস্থানের ছায়া চাপিয়ে দিচ্ছি, বাখতিনের ভাববিশ্ব থেকে অর্জিত সম্বোধ্যমানতার প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্তও করতে পারছি না।

 বিশ শতকের শেষে আধুনিকোত্তরবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের উদ্ধত যুগলবন্দি জীবন থেকে ক্রমাগত মানবিক নির্যাস শুষে নিয়েছে। পরিসর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গভীরতা আর সময় থেকে ব্যাপ্তির বোধ। তাহলে প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা বা সম্বোধ্যমানতাকে কীভাবে জাগিয়ে রাখব আজ? কীভাবেই বা বাখতিনের চিন্তাবীজ পুষ্পিত হবে আমাদের অনিকেত এবং পারম্পর্যহীন অবস্থানে? পরিবর্তনের স্রোতে আমরা এখন দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ভেসে যাচ্ছি। বাখতিনের জীবনেও মুহুর্মুহু পরিবর্তন ঘটেছিল, ইতিহাসের কত বিচিত্র পর্যায়ের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছিল—ইতিমধ্যে তা জেনেছি আমরা। তাঁর জীবন ও মননের নিরবচ্ছিন্ন দ্বিরালাপের গ্রন্থনায় ইতিহাসের বহুস্বরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাখতিন নিজে যাকে মহাসময় (Great time) বলেছেন, তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছিল তারই মধ্যে। কিন্তু আমরা যারা আধুনিকোত্তর ভাবনার নিরিখে ইতিহাসকে মহাসন্দর্ভ বলে প্রত্যাখ্যান করতে শিখেছি, বাখতিনের জীবন-নিষ্পন্ন প্রত্যয় কি আমাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচিত হবে! বাখতিন চিন্তা-প্রস্থানের আলোচনায় অতিউদ্ভাসিত প্রথম বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের উৎসাহ যেহেতু সবচেয়ে বেশি, তাদের আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক রাজনীতির অভিপ্রায় ও রণকৌশল কি আদৌ ভুলে থাকা সম্ভব? তৃতীয় বিশ্বের জিজ্ঞাসুরা কীভাবে বিশ্বাস করবেন যে প্রথম বিশ্বের বাখতিন-ভাষ্য—‘প্রতিটি সত্তাই সহযোগী সত্তা’ কিংবা ‘সত্তা মানে সমান্তরালতার বোধ’ বা অংশীদার হওয়ার প্রত্যয়’—এইসব মহাবাক্য আন্তরিকভাবে স্বীকৃত হবে? কার্নিভাল তত্ত্বে অন্তর্বৃত প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের নির্যাসকে কিংবা বাখতিনীয় তাৎপর্যতত্ত্বে

১০১