পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

nonutopian, nontheologian, in a word a non-modernist’ (তদেব: ৪) তাত্ত্বিক। আসলে এত দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করার পরেও বাখতিন রয়ে গেছেন রহস্যময়, এমনকী কিছুটা প্রহেলিকাও। তাঁর তত্ত্ববিশ্ব কতটা স্ববিরোধী কিংবা অসম্পূর্ণ—এই আলোচনাও কম হয়নি। বিশেষত সাম্প্রতিক বঙ্গীয় আলোচকদের একটা অংশ এ-বিষয়ে অত্যন্ত উৎসাহী। প্রতিবেদনের মধ্যে অন্ধবিন্দু থাকাটা অবশ্য অস্বাভাবিক নয়। স্বয়ং বাখতিন সার্থক বয়ানকে মুক্ত পরিসরের দ্যোতক বলে ভাবতেন। নিরন্তর প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন বলে তাঁর কাছে শেষ কথা বলে কিছু ছিল না।


দুই

সুতরাং বাখতিন কী করতে পারেননি, সেই অপূর্ণতার ওপর বেশি মনোযোগ না দিয়ে আমরা তাঁর দ্রষ্টাচক্ষুর ব্যাপ্তি ও গভীরতার পরিমাপ করতে পারি। লক্ষ করতে পারি, কীভাবে যথাপ্রাপ্ত বাস্তবের মধ্যেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন স্বর ও স্বরান্তরের অজস্র সম্ভাবনা, খুঁজে পেয়েছিলেন বস্তু ও ক্রিয়ার বিনির্মাণের তাগিদ। চিন্তার ঔচিত্য নয়, চিন্তার স্বভাবই অন্বিষ্ট ছিল তাঁর। কীভাবে ভাবনার সীমান্তগুলি অনবরত মুছে যাচ্ছে এবং তার ফলে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের কূটাভাস—বাখতিন আমাদের সেদিকে মনোযোগী হতে প্রাণিত করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালির আস্তিত্বিক পরিসরে কীভাবে গৃহীত হচ্ছেন বাখতিন—তার প্রকৃত মূল্যায়ন করা সহজ নয়। তবে জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিসরে প্রতীচ্যের ভাষ্যকারদের চোখ দিয়ে বাখতিনকে দেখার ফলে কিছু কিছু নেতিবাচক মনোভঙ্গি নিঃসন্দেহে তৈরি হয়েছে। এর সমাধান যদি করতে চাই, কর্তৃত্ববাদের কৃৎকৌশল থেকে তাৎপর্য সন্ধানের প্রক্রিয়াকে আগে মুক্ত করতে হবে। সারা জীবন ধরে যিনি বাচনবিশ্বের যোগ্যতা পরীক্ষা করে গেছেন, তাঁকে টুকরো করে দেখা চলে না কখনো। ভরসার কথা, কোনো কোনো বাঙালি তত্ত্বজিজ্ঞাসু ও আলোচক এবিষয়ে ক্রমশ অবহিত হয়ে উঠেছেন। এই উপলব্ধি উত্তরোত্তর গাঢ়তর হয়ে উঠছে যে এই জগৎ যতটা বাস্তব ততটাই রূপক। চিহ্নায়িত জগতে সত্যে পৌঁছানোর পথে সবচেয়ে বড়ো বিঘ্ন হলো প্রাতিষ্ঠানিকতা বা সরকারি বয়ানের রক্ষণশীলতা। বহুস্তরান্বিত পাঠকৃতিতে সমস্ত অন্তর্বয়ন প্রকাশ্য নয়, রয়েছে বহু গোপন বা অনতিগোপন গৌণ পাঠও। গত দশ বছরে বেশ কয়েকজন সমালোচক বাখতিন চর্চায় অংশগ্রহণ করেছেন।

 কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা বলা যাচ্ছে না যে তৃতীয় বিশ্বের অপর পরিসরের উপযোগী যথাপ্রাপ্ত স্থিতির গভীর তাৎপর্য বাঙালি ভাবুকেরা ঈপ্সিত মাত্রায় নিঙ্‌ড়ে নিতে পেরেছেন। বাখতিনের যে-সমস্ত ভাববীজ বাঙালির নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির জমিতে বহুধা-অঙ্কুরিত হতে পারত, তা হয়নি। তবে এটা ঠিক যে দেবেশ রায় প্রবর্তিত উপন্যাসতত্ত্বমূলক আলোচনার প্রভাব নবীন প্রজন্মের কয়েকজন প্রাবন্ধিকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে ব্যাপৃত হয়েছেন কয়েকজন উজ্জ্বল কথাকার। কিন্তু আবারও লিখছি, বাখতিনীয় দ্বিরালাপ থেকে যে নবায়মান প্রত্যুত্তরযোগ্যতার বহুমুখী কর্ষণ হতে পারত, তা এখনও অপেক্ষিত। তেমনই কার্নিভালের সাংস্কৃতিক রাজনীতির তাৎপর্য এবং সেই তাৎপর্যের বিস্ফোরক তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক সম্ভাবনা আমাদের অভিনিবেশ পায়নি। জীবন-জগৎ-সাহিত্যের প্রতিবেদন কীভাবে অনবরত পুনঃপাঠ করে যেতে হয়, সেই ভাবনার উদ্ভাসন আমাদের মানববিশ্বের প্রতীতিকেই সমৃদ্ধতর করতে পারত। বিশেষত ভারতীয়

১০৩