পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চিত্তাকাশের শরিক হয়েও আমরা বাখতিনীয় ভাবকল্পকে আমাদের মানবিক মহাকাশে উত্তীর্ণ হওয়ার যাত্রায় কোনো অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায় হিসেবে ব্যবহার করতে পারি কি না, তা গভীর বিবেচনার বিষয়। গত কয়েক বছরের সাহিত্যপ্রেক্ষিত পর্যবেক্ষণ করে মনে হয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জীবনবীক্ষার মধ্যবর্তী জলবিভাজনরেখা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। পক্ষ-প্রতিপক্ষের দ্বন্দ্ব যেন প্রাসঙ্গিক নয় আর, বিচিত্র সমগ্রায়নের প্রবণতায় কেন্দ্রাতিগ ও কেন্দ্রাভিগ বয়ানের পার্থক্য অবান্তর হয়ে যাচ্ছে। আধুনিকোত্তর পরিস্থিতির নামে আরোপিত প্রতিনন্দনের কাছে স্বেচ্ছায় সমর্পিত হচ্ছে বাঙালির লিখন-প্রণালী। বাখতিনের কার্নিভাল সংক্রান্ত ভাবনার নির্যাস থেকে এক্ষেত্রে হয়তো আমরা প্রতিরোধের ভিন্ন প্রকরণ খুঁজে নিতে পারতাম।

 না, এসব কোনো আক্ষেপের কথা নয়। বিশ্বব্যাপ্ত নির্মাণবায়ন প্রবণতার মধ্যে আমাদের অজস্র স্ববিরোধিতা-লাঞ্ছিত সাংস্কৃতিক সমাজ কীভাবে আত্মরক্ষা করতে পারে—এটাই সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। এ ব্যাপারে কতটা সাহায্য করতে পারেন বাখতিন, সেটাই আমাদের ভেবে দেখতে হবে এখন। ইতিহাসই বাঙালির পরিসরকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। ফলে অসংখ্য উচ্চাবচতা, কৌনিকতা ও অনিশ্চয়তা সম্বল করে বাস্তুহীন মানুষের প্রব্রজন আজও অব্যাহত। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার মাত্রা যেহেতু আলাদা, জীবনবীক্ষায় ভিন্নতার অভিব্যক্তিও অনিবার্য। বস্তুত প্রাক্-আধুনিক, আধুনিক ও আধুনিকোত্তর চিন্তাপ্রণালীর সহাবস্থান তাই বাঙালির ভাববিশ্বকে গ্রন্থিল করে তুলেছে। সাহিত্যকর্মে আধার ও আধেয়ের দ্বিরালাপ নানাভাবে ব্যক্ত হচ্ছে। স্বভাবত প্রত্যুত্তরযোগ্যতা অর্জনের প্রশ্নটি সমস্ত বাঙালির দ্বারা একই ভাবে মীমাংসিত হতে পারে না। বিভিন্ন অবস্থানের সীমান্তগুলিকে কীভাবে গ্রহণ করতে পারি আমরা, এ-বিষয়ে বাখতিনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ নেওয়া সম্ভব। বিশেষত বাস্তব ও অধিবাস্তব, বস্তুবিশ্ব ও চিহ্নবিশ্ব ইদানীং যেভাবে সাহিত্যিক প্রতিবেদনে একাকার হয়ে যাচ্ছে, নতুনভাবে দ্বিরালাপের যৌক্তিকতা নির্ণয় করা অবশ্যকৃত্য হয়ে পড়েছে। বাংলা সাহিত্যে আখ্যানের স্বরান্তর সম্পর্কে সাম্প্রতিক কালে যে অভিনব সচেতনতার সূচনা হয়েছে, তাকে বাখতিনীয় ভাবকল্প দিয়েই যথার্থ বিনির্মাণ করা সম্ভব। একটু আগে বাঙালির বাধ্যতামূলক প্রব্রজনজনিত চিন্তা ও অভিব্যক্তির যে অনেকান্তিকতার প্রতি ইঙ্গিত করেছি, সেই সূত্রে বলা যায়, বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে সৃজনশীলতার কৃত্যে রূপান্তরিত করার পথ-নির্দেশ বাখতিনই দিতে পারেন। তাৎপর্যের রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে নৈঃশব্দ্য ও অনুপস্থিতির যত ভূমিকাই থাক, কৃত্যের নির্মিতিপ্রকরণ শুধুমাত্র তাদের ওপর নির্ভর করে না। এখানেই বাখতিন-কথিত সক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা আমাদের মনে পড়ে।

 বাখতিনীয় ভাবকল্পকে সম্প্রসারিত করে ক্যারিল এমার্সন ‘co-existent options in space’ (প্রাগুক্ত: ১৬)-এর কথা বলেছেন। এই কথাটি বহুধাবিচ্ছিন্ন বাঙালির সাম্প্রতিক অবস্থানে খুব জরুরি চিন্তাসূত্র হয়ে উঠতে পারে। আরেকজন বাখতিন-বিশেষজ্ঞ, মিখায়েল এপস্টাইন, ১৯৯৩ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন: ‘Post-humanism, post-communism, post-modernism—the river of time has entered an ocean and lost its fluency altogether.’ (তদেব)। এ হয়তো বাঙালির পৃথিবী সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়; কিন্তু তবু আজকের অধিপরিসর শাসিত নব্য-বহুত্বের পর্যায়ে এই ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে

১০৪