পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১০৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বিবেচনা করতেই হয়। লিখন-বিশ্ব ও তার বিচিত্রগামী ভাষ্যকে যদি সংহত ও গভীরতা-সন্ধানী করতে চাই, তাহলে বাখতিনের দ্বিবাচনিক ভাষাদর্শনের ওপর আস্থা রাখতে হবে। রচনাকর্ম, সমালোচনা ও তত্ত্বসন্ধানে আমরা আজ কেবল বর্তমানকেই গুরুত্ব দেব না, অতীত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির পুনঃপাঠও করব। অর্থাৎ বাখতিন আমাদের সময় ও পরিসরের আবহমান পর্যায়ক্রমগুলিকে পুনর্বিন্যস্ত করেন। এই সূত্রটির প্রণালীবদ্ধ অধ্যয়ন থেকে আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে পুনর্বিবেচনা করার রসদ সংগ্রহ করে নিতে পারি। গ্রেগরি ক্লার্ক তাঁর Dialogue, Dialectic and Conversation বইতে লিখেছেন: ‘for people studying rhetoric and compostion as well as for those studying literature, Bakhtin’s work provides perhaps our most comprehensive explanation of the process through which social knowledge is constructed in a co-operative exchange of texts. However diverse its particular applications. Bakhtin’s explanation persistently and explicitly affirms the two complementary assumptions about language that support a social constructionist point of view: that our language creates rather than conveys our reality. …and that it does so in a process that is collaborative rather than individual.’ (পৃ. ৮-৯)।

 এই মন্তব্যের প্রতিটি অংশ বাংলা সাহিত্যের নিবিড় পাঠে দিক্‌দর্শক বলে বিবেচিত হতে পারে। সামাজিক নির্মিতিবাদী দৃষ্টিকোন ছাড়া নান্দনিক সত্য ও সেই সত্যের ঐতিহাসিক তাৎপর্য বোঝা সম্ভব নয়। বাখতিনের কাছে পাওয়া নির্মিতিবিজ্ঞান সম্পর্কিত ধারণা কিংবা ‘speech genre’-গুলির অন্তর্নিহিত সামাজিক মাত্রা নির্ণয়ের পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে আমরা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন পর্যায়ে রূপান্তরিত প্রতিবেদনের যথার্থ তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারব। এটা ঠিক যে বাংলা বিদ্যাচর্চা, বিশেষভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে, অত্যন্ত মন্থর গতিতে বিবর্তিত হলেও বহুকাল ধরে প্রচলিত রক্ষণশীলতা একটু একটু করে বিচলিত হতে শুরু করেছে। বাখতিন বিশ্বাস করতেন, আমাদের লিখিত বা মৌখিক অভিব্যক্তির কৃত্য বা উদ্যম দুরূহ অন্তর্বৃত সংগ্রামের পরিণতি। আমাদের ব্যক্তিগত ও সামূহিক অতীত ও বর্তমানের অজস্র উচ্চারণ অন্যোন্য-সম্পৃক্ত হয়ে ভাষার সামাজিক ঊর্ণাতন্তু গড়ে তোলে এবং গড়ার ঐ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই প্রাগুক্ত সংগ্রামে যুক্ত হয়ে যায়। এইসব উচ্চারণে যাবতীয় অপর পরিসরের উপস্থিতি স্বতঃসিদ্ধ ও অন্তরীকৃত। স্বর ও স্বরান্তরের বিন্যাস-প্রতিন্যাসের গ্রন্থনা স্বভাবে দ্বিবাচনিক। সাহিত্যের বিভিন্ন পর্যায়ে অন্তহীন দ্বিরালাপের উপস্থিতি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অনুভূত হয়ে থাকে।


তিন

বাচন সম্পর্কে বাখতিনের দ্যোতনাময় সমৃদ্ধ ভাবনা কি কম্পিউটার প্রযুক্তির সাম্প্রতিক পর্যায়ে অলংকৃত ভার হিসেবে গণ্য হবে? মুদ্রিত শব্দের জগতে অতি দ্রুত যেসব অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে, তাতে বাচন ও পরাবাচন সংক্রান্ত সূক্ষ্ম চিন্তা এবং সেই চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা সন্দর্ভ-পরাপাঠ-অন্তর্বয়ন বিষয়ক ধারণা কি ইতিহাসের মহাফেজখানায় ঠাঁই পাবে? সাহিত্য-সমালোচনা ও সাহিত্যতত্ত্ব যেমন নিরালম্ব হয়ে পড়বে, তেমনি মানবতাবাদী মূল্যমানও ছিন্নমূল হতে বাধ্য। কম্পিউটারের পর্দায় অকল্পনীয় দ্রুত গতিতে

১০৫