পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পার্থিবতায় সম্পৃক্ত সাহিত্যবোধই প্রতীত বাস্তবের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসে প্রত্যাহ্বানের মুখোমুখি। দাতা ও গ্রহীতার অত্যন্ত মৌলিক ও আবশ্যিক দ্বিবাচনিক গ্রন্থনা আর পারস্পরিক প্রত্যুত্তরযোগ্যতা আজ কেবল তাত্ত্বিক ভাববীজ মাত্র নয়; সর্বগ্রাসী উদ্ধত প্রতাপের বিরুদ্ধে সাহসী সাংস্কৃতিক যুদ্ধেরও হাতিয়ার। অর্থাৎ একুশ শতক যদি বা আধুনিকোত্তর অবভাসবাদের কল্যাণে ভবিষ্যবাদী মায়া ছড়িয়ে দিয়ে নব্য রোমাণ্টিক প্রতিজগতের বার্তা বয়েও আনে, সর্বপ্লাবী মূল্যহীনতা থেকে সম্ভাব্য মূল্য-চেতনায় পৌঁছানোর দ্বিবাচনিক সংঘর্ষের পথ মানুষকেই নির্মাণ করে নিতে হবে। একুশ শতকের সাহিত্যে বাচনের আপাত-নির্বাসনের আশঙ্কা সত্ত্বেও সত্যোপলব্ধির এই নব্যপ্রযুক্তি মানুষকেই আবিষ্কার করতে হবে। সুতরাং বাখতিন-কথিত নির্মিতিবিজ্ঞানের তাৎপর্য পুনর্নির্ণয়ের প্রক্রিয়া রুদ্ধ হতে পারে না। পুনর্নির্মাণের এই প্রকরণে হয়তো অঞ্চলভিত্তিক, ঐতিহ্যভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক অপরতার বর্গগুলিও পুনর্নির্মিত হবে। কিন্তু যা-ই ঘটুক, দ্বিবাচনিকতা থেমে থাকবে না।

 প্রযুক্তির ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা যত চোখ ধাঁধিয়ে দিক বা বিভ্রান্ত করুক, ইতিহাসের ধুলোয় নিশ্চয় মানুষের এতদিনকার সাহিত্যকৃতির পরম্পরা মিশে যাবে না। যেভাবে বাচনের, উপন্যাসের প্রাক্-ইতিহাস খুঁজে পেয়েছেন বাখতিন, আমরাও একদিন প্রাক্-বিশ্বায়িত ও বিশ্বায়নোত্তর প্রযুক্তির নতুন অর্থ আবিষ্কার করে নেব। খুঁজে নেব প্রাক্-নির্মাণবায়ন ও নির্মাণবায়নোত্তর স্তরের নতুন চিহ্নতত্ত্ব। ইতিহাস-বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্যে নয়, সম্ভাব্য আগামী কালের সঙ্গে ঐসব তাৎপর্যের দ্বিরালাপের সূত্র খুঁজে নেওয়ার জন্যে। সংকট থেকেই যেহেতু সমালোচনার জন্ম হয় এবং অবশ্যই জন্ম হয় নব্যপাঠকৃতিরও—আমাদের আসন্ন সাহিত্যচর্চায় বাখতিনীয় ভাববিশ্বের সঙ্গে নতুন পরিচয় ঘটবে আমাদের। প্রতাপের বিচ্ছুরণে অভিভূত আমাদের মন; প্রচারিত হচ্ছে বহুত্ববাদের জয় অথচ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার আঙরাখা। সমস্ত অপর পরিসরের সমান্তরাল অবস্থানের অধিকার যখন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, দৃষ্টির বহুত্ব কিংবা উদ্বৃত্ত তো কাগুজে কথা হয়েই থাকবে। যেহেতু বাখতিনের বয়ান ‘canonical texts of the academy’-র দৃষ্টান্ত নয়—আজকের দিনের প্রয়োজনীয় পুনস্তত্ত্বায়নের প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে তাঁর উন্মুক্ত চিন্তাপরিসর থেকে। পৌর সমাজ ও রাজনৈতিক সমাজের পাশাপাশি ইদানীং যে নতুন তথ্য-বিস্ফোরিত তথ্য-উন্মুখ তথ্যগ্রাহী সমাজের সূত্রপাত হয়েছে, তার মোকাবিলা করতে হলে বাংলা বিদ্যাচর্চাকে নিরাসক্ত ও ছদ্ম-নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান পরিহার করতে হবে।

 কেউ কেউ বলছেন, বাচনিক বনাম দৃশ্যগত আখ্যানের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া ক্ষতিকর এখন। গ্রহীতাসত্তা যেহেতু নিছক গ্রহীতা নয় আর, ভোত্তাসত্তাও—আমাদের বহু দৃঢ়ভোথিত ভাবনা হঠাৎ নিরালম্ব হয়ে পড়ছে। অভিনব সমস্যার সমাধান পুরোনো পথে হওয়া শক্ত। যখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ‘গন্তব্য’ পথকে নিয়ন্ত্রণ করত, সেই পর্যায় থেকে সরে এসেছি আমরা। তাহলে, সন্দর্ভ থেকে প্রতিসন্দর্ভে পৌঁছানো যথেষ্ট নয়; ‘উপস্থাপনা’র প্রায়োগিক তাৎপর্যকে বহুদূর প্রসারিত করতে হবে। সেই সূত্রে প্রত্যুত্তরযোগ্যতার ধারণাকেও সব গণ্ডি ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে অনন্ত স্থিতি-স্থাপকতার সম্ভাবনায়। যাঁরা বলছেন লেখকের বয়ানকে এখন রূপান্তরিত করতে হবে—‘to digital, on-line forms of expression...from linear page to digital hypertext and multimedia visuals to more holistic electronic forums’—তাঁরা স্পষ্টত সময়ের অতি-সপ্রতিভ নব্য

১০৭