পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কার্নিভালের রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নিতে চাইছেন। কিন্তু আমাদের মনে সেই পুরোনো অবোধ প্রশ্নই জেগে ওঠে আবার: অতঃ কিম্? যে-কোনো মূল্যে টিকে থাকতে হবে—এই কি অস্তিত্বের সংজ্ঞা? বিশ্বব্যাপ্ত তথ্য রাজপথ দিয়ে ছুটে যেতে যেতে লক্ষ করতে পারব কি বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন, ভোগ-প্রযুক্তির ক্যাসিনো, বস্তু ও চিহ্নের স্বাতন্ত্র্যের অভিজ্ঞান কীভাবে পলক ফেলতে-না-ফেলতে বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে ততোধিক দুর্বার বেগে ধাবমান নেতি ও নৈরাজ্যের কৃষ্ণবিবরে?

 আসলে সময়ের পর্বে-পর্বান্তরে যুদ্ধের সংজ্ঞা, যুদ্ধক্ষেত্র, যুদ্ধের সরঞ্জাম, যুদ্ধকৌশল পালটে যায়। একুশ শতকের প্রারম্ভিক দশকে অন্তত এইটুকু বুঝতে পারছি যে আগামী দিনগুলিতে মানবিক অন্তঃসার সংরক্ষিত করে রাখার মতো আপাত-প্রাথমিক কাজই হবে বড়ো ধরনের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বাখতিন আমাদের সঙ্গে থাকবেন; তাঁর তত্ত্ববীজগুলি হবে যুগপৎ আত্মরক্ষার প্রকরণ ও প্রত্যাঘাতের আয়ুধ। বাখতিন জানতেন, দ্বিবাচনিকতা অন্তহীন; তা সর্বত্র ও সর্বকালে রয়েছে। বস্তুত এই প্রক্রিয়ার শক্তিতেই মানুষ অপরাজেয়, মানবিক নিষ্কর্ষ কালাতিযায়ী। নইলে ভাষা হারিয়ে যেত, মুছে যেত সাহিত্যিক প্রতিবেদন। সুনির্দিষ্ট সময়পর্বের সীমা ও বাধ্যবাধকতা পেরিয়ে গিয়ে ভাষাই শুধু সঞ্চরমান থাকে, গ্রাহক-সত্তায় সঞ্চারিত করে তার ঐশ্বর্য ও গভীরতা; আত্মদীপ ও অনন্যশরণ হয়ে ওঠে মানুষ। আজকের গোলকধাঁধা তাই এমন বন্দীশালা হতে পারে না যা-থেকে মুক্তি নেই। ভাষায় দীপ্যমান মানুষ কখনও তাৎপর্যরিক্ত হতে পারে না। যা-ই ঘটুক অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে, বাচনের যুদ্ধ অক্ষুণ্ণ থাকবে। এ-সময়ে বাখতিনচর্চা তাই এই যুদ্ধে সক্রিয় পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদানেরই অঙ্গীকার। Speech Genres and Other Late Essays থেকে আরও একবার তুলে আনি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উচ্চারণমালা: ‘There is neither a first nor a last word and there are no limits to the dialogic context (it extends into the boundless past and the boundless future). Even past meanings that is, those born in the dialogue of the past centuries, can never be stable (finalized, ended once and for all). They will always change (be renewed) in the process of subsequent, future developments of the dialogue. At any moment in the development of the dialogue there are immense, boundless masses of forgotten contextual meanings, but at certain moments of the dialogue’s subsequent development along the way they are recalled and invigorated in renewed form (in a next context). Nothing is absolutely dead; every meaning will have its homecoming festival.’ (১৯৮৬: ১৭০)

 এসময় অর্থবোধে পৌঁছানোর সমস্ত পথ যখন আধিপত্যবাদী শক্তি-সমবায়ের দ্বারা আক্রান্ত, বাখতিন-ই হতে পারেন নবায়মান দ্বিরালাপের বহুস্বরিক উৎস। রুদ্ধতা থেকে নতুন উন্মোচনে উত্তীর্ণ হওয়ার দিশা পেতে পারি তাঁর ইঙ্গিতময় চিন্তাবিশ্বে। এভাবেই সময়ের বিভ্রান্তি ও বিদূষণকে কার্যকরী ভাবে মোকাবিলা করতে পারি আমরা, তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক অবস্থানে থেকেও।

১০৮