পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/১৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

প্রাক্‌কথন ১

 এমন একটা সময়ও ছিল আমাদের যখন ‘তত্ত্বকথা’ জাতীয় শব্দ ছিল অস্পৃশ্য; জিজ্ঞাসা থেকে সব মহিমা ঝরে গিয়েছিল। ব্যঙ্গ বিদ্রূপের সহজ লক্ষ্য হিসেবে ‘তত্ত্ব’ ছিল অদ্বিতীয়। বলা বাহুল্য, সাহিত্য-আলোচনায় তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে যত আপত্তি। এবং, এবিষয়ে আমরা ঘোর জাতীয়তাবাদী। পদার্থবিদ্যায় নিউটন-আইনস্টাইন-কে যারা ছাড় দেয় এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সমস্ত শাখায় আন্তর্জাতিক নাগরিক হতে পারে সোৎসাহে— তাদের যত আপত্তি সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে। বিশ্বায়নের শুরু হওয়ার পরেও সাহিত্যচিন্তায় সীমান্ত-প্রহরা অটুট রয়ে গেছে। সাহিত্যে নতুন-নতুন চিন্তা প্রত্যাশিত। সেইসব ক্ষেত্রেও লক্ষ করি যুক্তিহীন দ্বিধা ও অনীহা।

 তবু মিখায়েল মিখায়েলোভিচ বাখতিনের বিস্ফোরক আবির্ভাব হলো। সত্তর দশকে ইংরেজি অনুবাদে তার রচনা পড়ার পরে। মুখ্যত, দেবেশ রায়ের উদ্যম বাখতিনকে উৎসুক বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। ফুকো-বার্ত-দেরিদা-জেমসন-বদ্রিয়ারের প্রতি কেউ-কেউ হয়তো সামান্য মনোযোগী। কেননা আধুনিক ও আধুনিকোত্তর কালপর্বের জটিলতা ব্যাখ্যায় প্রতীচ্যের এই তাত্ত্বিকেরা অগ্রণী। তত্ত্বকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে চান যাঁরা, সেইসব পাঠকদের কথা বলছি না। বলছি সেই জিজ্ঞাসু পড়ুয়াদের কথা যাঁরা জানেন, জীবনের প্রতিটি পাঠই তত্ত্বের পাঠ।

 বাখতিনের স্বাতন্ত্র্য ঠিক কোথায়— তা অনুশীলন করতে গিয়ে দেখি, তিনি আমাদের যাবতীয় ভাবপিঞ্জর থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে প্রাণিত করেছেন। বাখতিনের তত্ত্ববীজগুলি স্বভাবে আকরণোত্তরবাদী। তাই কোনও ধরনের রুদ্ধতায় এরা কখনও বিকশিত হয় না। বাখতিনের ভাববিশ্ব এমন যে বারবার পুনঃপঠিত হওয়ার মধ্যেই তার সার্থকতা প্রমাণিত ও পরীক্ষিত হয়ে থাকে। তাঁর তত্ত্ববিশ্বের আরও একটি প্রধান ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য হলো, অন্যান্য চিন্তা-প্রস্থান কিংবা চিন্তাবীজের সঙ্গে দ্বিরালাপে তার বিকাশ ত্বরান্বিত হয় আরও। নিশ্চিহ্নায়ন ও প্রতিরূপায়ণের তোড়ে, আকাঙ্ক্ষার প্রতাপে সমকাল যখন প্লাবিত—কোনও কল্পিত স্বর্গের ইশারা পাই না তাঁর কাছে। এ মুহূর্তে ঠিক কোথায় নোঙর ফেলতে পারে চেতনা, এই জিজ্ঞাসা নিয়েই যাই বাখতিনের কাছে।

 তিনি আমাদের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন না। হয়তো মুক্তি ও শীর্ষবিন্দুর তাৎপর্য বদলে গেছে এখন। সমাজের কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়েছে ইতিহাস, মানবতন্ত্র ও নান্দনিক চেতনা। তবুও অনবরত অস্তিত্বের নবায়মান নির্মিতি-প্রকরণ সম্পর্কে আমাদের অবহিত থাকতেই হয়। বারবার তৈরি করে নিতে হয় নিজেদের প্রত্যুত্তরযোগ্যতা, অপরতার সঙ্গে সত্তার সংযোগ-প্রকল্প। প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের সর্বব্যাপ্ত বিয়োগপর্বে বাখতিনের পথ ও পাথেয়কে কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত করা সম্ভব? শুধু তো আধুনিকতাই নয়, আধুনিকোত্তর পরিস্থিতিও বিস্ফোরিত হয়েছে আমাদের চারপাশে। জাঁ বদ্রিয়ার বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে এসেছে মুক্তির মুহুর্ত: ‘Political liberation, sexual liberation, liberation of the forces of production, liberation of the forces of destruc-

১১