পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৩৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

যেন প্রচ্ছন্ন রয়েছে রূপকথার দ্যোতনা। যেন বা বিচিত্র ব্যঞ্জনাময় উপায়ে বাখতিনের জীবন তাঁর তত্ত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠল: সমাপ্তি বলে কিছু নেই কোথাও, নেই কোনো চূড়ান্ত বিন্দু। তা না-হলে অনেকদিন আগে—সেই ১৯২৯-এই তাঁর জীবন রূঢ় অকাল-সমাপ্তিতে শেষ হতে পারত। ঐ বছর বাখতিনের ডস্টয়েভস্কি-বিষয়ক বিখ্যাত বইটি স্বনামে প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই লেনিনগ্রাদের বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীর মতো বাখতিনকেও গ্রেপ্তার হতে হলো। স্ট্যালিনের শাসনকালে তাঁর একটি মাত্র নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল যদিও সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। ত্রিশের দশকের শেষে বাখতিন রাবেলে সম্পর্কে গবেষণা নিবন্ধ লিখে সোভিয়েত বুদ্ধিজীবীদের মূলস্রোতে পুনঃপ্রবেশ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু নানা অজুহাতে ঐ নিবন্ধের স্বীকৃতি কয়েক বছর পিছিয়ে গেল। এমন কি স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরেও বাখতিনের প্রকাশনাভাগ্য খুব একটা পাল্টায়নি। মোর্দোভিয়ার পরিচিতি কাজে লাগিয়ে তিনি একটি দু’টি নিবন্ধ মাত্র ছাপতে পেরেছিলেন। সুতরাং ১৯২৯-এর পরে বৌদ্ধিক জগতের কাছে বাখতিন কার্যত ছিলেন অস্তিত্বহীন। ষাটের দশকের গোড়ায় অবস্থাটা নাটকীয়ভাবে বদলে গেল। মূলত তিন-চারজন অনুরাগীর প্রবল চেষ্টায় ১৯৬৩-তে ডস্টয়েভস্কি-বিষয়ক বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোল এবং ১৯৬৫-তে প্রকাশিত হলো রাবেলে-বিষয়ক বইটি। অতিদ্রুত বাখতিন তরুণতর প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠলেন নতুন ভাবনা-প্রস্থানের কৃষ্টি-নেতা। শুরু হলো অতীতের বিলীয়মান দিগন্ত থেকে বাখতিনের পুনরাবিষ্কার এবং তাঁর চিন্তাবৃত্তের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ।

 কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ায় তাঁর এই বিস্ময়কর পুনর্বাসনের চেয়ে ইংরেজি-জানা দুনিয়ায় আবিষ্কার অনেক বেশি আশ্চর্যজনক। ১৯৬৮-তে রাবেলে ও তাঁর জগৎ প্রকাশিত হওয়ার পরে প্রতীচ্যের ভাববিশ্বে অভূতপূর্ব বিস্ফোরণ ঘটে গেল যেন। প্রকৃতপক্ষে গত চল্লিশ বছর ধরে বাখতিনের প্রভাব অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বেড়ে গেছে। রাশিয়ায় ও বহির্বিশ্বের গবেষকদের অক্লান্ত অধ্যবসায়ে তাঁর বিভিন্ন বই ইংরিজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তাঁর ভাববৃত্ত বিশ্লেষণে ও পুনর্বিশ্লেষণে ক্রমাগত প্রসারিত হয়ে চলেছে। সাহিত্যতত্ত্ব ছাড়াও ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্বদর্শন, সমাজতত্ত্বের বিচিত্র ক্ষেত্রে এবং নারীচেতনাবাদ, উপনিবেশোত্তর চেতনাবাদ, আকরণোত্তরবাদ প্রভৃতিতেও দেখা যাচ্ছে দিগন্ত-বিস্তারের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে বাখতিনের জীবনের নানা অনুপুঙ্খ এবং তত্ত্ব ও প্রয়োগের নানা স্তর পুরোপুরি নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। বস্তুত বাখতিন আজ এক নন, অনেক। তাই লেনিনগ্রাদের দিনগুলিতে বাখতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত পাভেল নিকোলায়েভিচ মেডভেডেভ (১৮৯১-১৯৩৮) ও ভ্যালেনটিন নিকোলায়েভিচ ভোলোশিনোভ (১৮৮৪/৮৫-১৯৩৬) যদিও তিনটে বই-এর রচয়িতা, তাঁদের ঘিরে এখন গড়ে উঠেছে বিচিত্র এক রহস্যবলয়। কেননা মনে করা হচ্ছে যে ঐ বইগুলি আসলে বাখতিনেরই লেখা এবং মেডভেডেভ রচনা-প্রক্রিয়ায় নামমাত্র অংশ নিয়ে থাকবেন। স্বভাবত পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে আসার আগে দৃঢ় তথ্যের যে জরুরি সমর্থন প্রয়োজন, তা এখন আর পাওয়া সম্ভবই নয়। সুতরাং বাখতিন ও বাখতিনের পত্নী কিছু কিছু সাক্ষাৎকারে যে -সমস্ত ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেইটুকুই আজ আমাদের একমাত্র ভরসা। বিশ ও ত্রিশের

৩১