পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হয়েছে, সাহিত্যিক প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে মৃত্যুর উপস্থাপনাকে গণ্য করা হয়েছে লেখকসত্তার আতিশয্যপ্রবণ নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ হিসেবে। তাই ডস্টয়েভস্কি-বিষয়ক বইতে বাখতিন টলস্টয়কে সমালোচনা করেছেন তাঁর লেখক-দৃষ্টির চূড়ান্ত অতিরেকের জন্যে; বিভিন্ন চরিত্রের মৃত্যু-বর্ণনায় টলস্টয়, বাখতিনের মতে, একবাচনিক সমাপ্তির বার্তা এনে দিয়েছেন। অন্যদিকে ডস্টয়েভস্কি তাঁর চরিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নতুন ধরনের লেখক-সত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন; আত্মচৈতন্যের মুক্ত সমাপ্তির প্রতি ঐ সম্পর্ক যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। এইজন্যে ডয়েভস্কির ঔপন্যাসিক অণুবিশ্বে দিবাচনিক কল্পনার শিল্পসার্থক অভিব্যক্তি ঘটেছে বলে বাখতিন মনে করেন। যথাপ্রাপ্ত জগতের সঙ্গে মানবসত্তার নিরন্তর সংঘর্ষের ধারণাকে তিনি নান্দনিক নির্মিতির বিষয় করে তুলেছেন: তাঁর ভাষায়, ‘organizing form-and-content center of artistic vision’ (১৯৯০: ১৮৭)। শব্দ বা বাক্য কথনশিল্পের নিয়ন্তা নয়; বরং শৈল্পিক অন্তদৃষ্টি শব্দ ও বাক্যকে সংগঠিত করে মানবসত্তার নিবিড় উপলব্ধিকে মূর্ত করে তোলে।

ছয়

 আখ্যানে বিভিন্ন চরিত্রের প্রত্যক্ষ উক্তিতে প্রতিফলিত হয় তাদের স্বরন্যাসের বৈচিত্র্য, জগতের প্রতি তাদের আবেগ ও মনন-জাত প্রতিক্রিয়া। আবার লেখকের পরোক্ষ উক্তিতে ঐসব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব মূল্যায়ন ধরা পড়ে। সুতরাং উপন্যাসের আখ্যানে ভাষা ও চেতনা দ্বিস্বরিক, অবশ্য দ্বিস্বরিক প্রতিবেদনের এই ধারণা আরো বিকশিত হয়েছে Marxism and the Philosophy of Language বইতে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাতে ক্রমশ গভীরতা ও ব্যাপ্তি যুক্ত হতে দেখি। যাই হোক, প্রাথমিক পর্যায়ের ঐ রচনায় বাখতিন এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন: ‘Every word in narrative literature expresses a reaction to another reaction, the author's reaction to the reaction of the hero; that is every concept, image, and object lives on two planes, is rendered meaningful in two value contexts —in the context of the hero and in that of the author (তদেব: ২১৮)। এভাবে তাঁর চিন্তাবিশ্বের প্রথম থেকেই শিল্প ও জীবনের মধ্যবর্তী বিভাজনরেখা ঝাপ্‌সা হয়ে গেছে। সত্তা ও অপরতার সৃষ্টিশীল অন্যোন্যনির্ভরতা সম্পর্কিত ধারণায় যে নৈতিক তাৎপর্য নিহিত রয়েছে, তাকে গভীরভাবে পরীক্ষা করা যায় যখন লেখক ও তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের নান্দনিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, ভোলোশিনোভ স্বাক্ষরিত ‘Discourse in the Life and Discourse in Art’ (১৯২৬) নামক নিবন্ধে পুরোপুরি বিপরীত বক্তব্য উত্থাপিত হয়েছে। তখন বাক্‌-শিল্পের উপলব্ধিতে পৌঁছানোর জন্যে দৈনন্দিন উচ্চারণের বিশ্লেষণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কেননা প্রকরণবাদী সমালোচনায় শিল্প-অভিব্যক্তিকে বিশুদ্ধ ভাষাগত নির্মিতি হিসেবে কার্যত বিমূর্তায়িত করে তোলা হচ্ছিল এবং সামাজিক প্রেক্ষিতের চলিষ্ণুতা থেকে তা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। অন্য আরেক ধরনের সমালোচনায় কোনো একক স্রষ্টার ব্যক্তিগত অহং বা মনস্তত্বের দর্পণে প্রতিফলিত হচ্ছিল শিল্পকর্ম। দুটোকেই সমানভাবে ভ্রান্ত মনে করেছেন বাখতিন, কেননা, তাঁর মতে, প্রতিটি নির্মিতি ভাবাদর্শের নির্মিতি এবং বাক্‌শিল্পও তার

৩৭