পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তিনি। তাই এখানে আমরা পেলাম তার মৌলিক বক্তব্য: ‘Any true understanding is dialogic in nature’ (১৯৭৩: ১০২)। ভাষার সঙ্গে চেতনা স্বভাবত সম্পৃক্ত; তাই মানবচৈতন্য সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত মন্তব্যও পাওয়া গেল: চেতনা অন্তর্বৃতভাবে সক্রিয়, সৃষ্টিশীল ও সামাজিক (‘The individual consciousness is a socio-ideological fact’ (তদেব: ১২)। চেতনা মানে তাৎপর্য, আর তাৎপর্য মানে মূল্যায়ন। বলা বাহুল্য, মূল্যায়ন সম্ভব শুধুমাত্র সামাজিক ও ভাবাদর্শগত অবস্থানের স্পষ্টতায়।

সাত

আমরা যাকে আত্মগত ভাবনা বলি, তার উৎস হলো সেই ‘সীমান্ত অঞ্চল’ যেখানে অন্তর্বৃত অভিজ্ঞতা ও সামাজিক জগৎ পরস্পরের সঙ্গে মেশে। এই মিলন ঘটে চিহ্নায়কের অর্থাৎ শব্দের মধ্য দিয়ে। সুতরাং উপলব্ধি মানে এক ধরনের চিহ্নায়কের সঙ্গে অন্য ধরনের চিহ্নায়কের অন্বয়। ভালোভাবে লক্ষ করলেই বুঝব, কেবলমাত্র চিহ্নায়ক অর্থ বহন করে থাকে। নিজের বাইরে গিয়ে অপরের প্রতীতি করানো তার দায়। যদি কখনো চেতনা থেকে চিহ্নায়ন প্রক্রিয়াকে নিশ্চিহ্ন করা যায়, তাৎপর্যের পরিসরও শূন্যে মিলিয়ে যাবে। চিহ্নায়কের প্রতি চেতনার সাড়া দেওয়াতে দ্বিবাচনিকতা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বহিঃপৃথিবীর অভিজ্ঞতা যখন অন্তর্জগতে আলোড়ন তোলে, প্রতিটি শব্দ থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে সামাজিক স্বরন্যাসের নানা বিভঙ্গ। এই প্রতীতি নিষ্ক্রিয় নয় কখনো, আবার এই সক্রিয়তাতেও নিহিত থাকে বিচিত্র বিপ্রতীপের সন্নিবেশ; একটি বাচন থেকে জেগে ওঠে প্রতিবাচন। এই তত্ত্ববীজকে বাখতিন পরবর্তী কালে, বিশেষভাবে জীবনের শেষ পর্বে, বাচনিক মাধ্যম সম্পর্কিত আলোচনায় আরো বিশদ করেছেন (দ্রষ্টব্য, ১৯৮৬ ৬০-১০২)। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আকরণ সামূহিক মিথষ্ক্রিয়াকে নিরন্তর বদলে দেয় বলে বিভিন্ন বাচনিক প্রতিবেদনে উচ্চারণের গতি ও প্রবণতা বিচিত্রগামী হয়ে ওঠে। একে ভোলোশিনোভ/বাখতিন চিহ্নায়কের ‘সামাজিক বহুস্বরিকতা’ (‘Social multiaccentuality’: ১৯৭৩: ২৩) বলেছেন যার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে শ্রেণী-বাস্তবতা অনুপ্রাণিত পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বিবাচনিক আয়তন। প্রতিটি যুগে সামাজিক প্রতাপের নিয়ন্তা শ্রেণী সমস্ত উচ্চারণকে একবাচনিক করে তুলতে চায়, নিজেদের সুবিধা-মাফিক একক তাৎপর্য চাপিয়ে দিতে চায় ভাষার উপর; কিন্তু সত্য যেহেতু দ্বিবাচনিক, প্রতিবাদী ভাবাদর্শ থেকে জন্ম নেয় সংঘর্ষপ্রবণ চিহ্নায়ক। এই প্রসঙ্গে বাখতিন আরো জানিয়েছেন, শব্দ আসলে দ্বিমুখী ক্রিয়া: বক্তা ও শ্রোতা, সম্বোধক ও সম্বোধিত—এই দুই মেরুর বিনিময়-নির্ভর সম্পর্কই শব্দের উৎস। প্রতিটি শব্দ তাই সত্তা ও অপরতার মধ্যে সেতু গড়ে দেয়। অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার উপলব্ধি; নিরন্তর বাচনিক সংযোগের শৃঙ্খলায় প্রতিটি উচ্চারণ তখন হয়ে ওঠে একক মুহূর্তের নির্মাণ।

 এই প্রসঙ্গে বাখতিন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাচন সম্পর্কে কিছু বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সীমারেখা ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে বলে একে অপরের মধ্যে অনেক সহজে হস্তক্ষেপ করতে পারে। সাহিত্যিক ও সামাজিক পাঠকৃতিতে

৩৯