পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।

রচনাটিকে আমরা ভাষা ও চেতনা বিষয়ে বাখতিনের অন্যতম মুখ্য সন্দর্ভ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। এখানে তিনি বলেছেন, পরস্পর-বিরোধী ও ভিন্নভিন্ন কণ্ঠস্বরের মিথষ্ক্রিয়া সৃজনী উদ্যোগের উৎস। যদি কোনো উপলব্ধি বিশুদ্ধ গ্রহীতার কাছেও নিষ্ক্রিয় থেকে যায়, তা বাচনকে নতুন কিছু দিতে পারে না। সামাজিক বিন্যাসের ব্যক্ত স্বরে পরস্পরভিন্ন উপকরণের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলেছে, এই নিবন্ধ সেদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বস্তুত উপন্যাসের প্রতিবেদনে দুটি সমান্তরাল শক্তির সংঘর্ষ নানা অনুষঙ্গে প্রকাশিত হয়ে থাকে বলে অনবরত বিচ্ছুরিত হচ্ছে নানা অর্থের দ্যোতনা। এভাবে এই নিবন্ধে বাখতিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নতুন পারিভাষিক শব্দ প্রয়োগ করেছেন—‘heteroglossia’ বা অনেকার্থদ্যোতনা। পাম মোরিস একে বর্ণনা করেছেন সেই শক্তি হিসেবে যা ‘stratifies and fragments Ideological thought into multiple views of the world’ (১৯১৪: ১৫)। তার মতে, এ হলো ভাষাকে ‘ideologically saturated and stratified’ বলে পর্যবেক্ষণের বিশেষ ধরন। অর্থাৎ ঐ অনেকার্থদ্যোতনার মধ্য দিয়ে আমরা উপন্যাসের ভাষাকে চিনতে পারি সামাজিক সংবেদনার বিশ্বস্ত প্রকাশ হিসেবে।

 বহুমুখী সামাজিক অন্তর্বয়নে গড়ে ওঠে প্রতিবেদনের অনেকার্থদ্যোতনা; স্বভাবত তাদের মধ্যে ভাবাদর্শের বিচ্ছুরণও অনিবার্য। কোনো-একটি নির্দিষ্ট সামাজিক বাচন থেকে একান্তিক সত্য কখনো প্রবল হয়ে ওঠে না উপন্যাসে কারণ অপর সব বিশ্ববীক্ষার উপস্থিতিতে প্রতিটি একক স্বরন্যাস আপেক্ষিক সম্পর্কসূত্রে জড়িত। এই পর্যায়ে বাখতিন আবার ফিরিয়ে এনেছেন দ্বিস্বরিক সন্দর্ভের প্রসঙ্গ। অনেকার্থদ্যোতনার পরিসরেও সক্রিয় থাকে আধিপত্যবিরোধী প্রতিবাচন; জেগে ওঠে কার্নিভাল। হাসি ও ব্যঙ্গ হয়ে ওঠে তখন মুক্তিকামী শক্তির প্রতীক। প্রতিবেদনে সামূহিক প্রতাপের সমস্ত সংকেতকে অন্তর্ঘাত করে ঐ কার্নিভাল। মনে রাখা প্রয়োজন, বাখতিনের তত্ত্ববিশ্বে গুরুত্বের দিক দিয়ে দ্বিবাচনিকতার পরেই কার্নিভালের স্থান। Rabelais and His world বইতে বাখতিন প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শক্তির সংঘর্ষের পটভূমিতে যখন রাবেলেকে উপস্থাপিত করেছিলেন, সেসময় তাঁর কাছে সরকারি মধ্যযুগ ও লোকায়ত সংস্কৃতির মৌলিক দ্বন্দ্ব বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকামী লোকায়ত মনন ‘কানির্ভাল চেতনা’র মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল, এই হলো বাখতিনের বক্তব্য। তার মানে, এখানেও চেতনার দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে দ্বিবাচনিক সংঘর্ষ। একদিকে মধ্যযুগীয় প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি অপরিবর্তনীয় জগৎ-বিধির স্থবির অচলায়তনকে চাপিয়ে দিতে চাইছে, অন্যদিকে কার্নিভাল চেতনা দাঁড়াচ্ছে গতি ও পরিবর্তনের চলিষ্ণুতার পক্ষে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে বাখতিন অনির্দেশ্য কোনো নৈরাজ্যবাদী শক্তিকে ভাষায় উদ্বোধিত করতে চেয়েছেন। বরং তিনি কার্নিভালকে দেখাতে চেয়েছেন তাৎপর্য-প্রতীতির জটিল পদ্ধতি হিসেবে। এটা কিন্তু সাহিত্যের প্রকরণ থেকে উদ্ভূত নয়; বহু শতাব্দী ধরে সঞ্চিত লোক-ঐতিহ্য (যেমন লোক-উৎসব, কথকতা, গাথানাট্য, গোষ্ঠীগত অনুষ্ঠান ইত্যাদি) থেকে আহৃত উপকরণের সংশ্লেষণে অর্জিত প্রতীকী অথচ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকরণ এর উৎসভূমি। এছাড়া আঞ্চলিক জনজীবনে প্রচলিত ব্যঙ্গ-পরিহাসময় আখ্যান থেকেও কার্নিভালের প্রতীতি হতে পারে। বাখতিন বিশেষভাবে তিনটে প্রাচীন প্রকরণের উল্লেখ করেছেন যাদের মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছেন কার্নিভাল চেতনা ও দ্বিবাচনিকতার

৪১