পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

প্রতিবেদনতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসুদের বহুকৌণিক বিশ্লেষণ সম্পর্কে অবহিত হয়ে আমরা বাঙালিরাও যেন দেশজ সাংস্কৃতিক স্বভাব ও আন্তর্জাতিক চেতনা-প্রেক্ষিতের দ্বিবাচনিকতার ক্ষেত্রগুল আবিষ্কার করে নিতে পারি।

 এই দ্বিবাচনিকতা ও ডায়লগের প্রামাণিকতা নিয়ে যাঁরা কিছুতেই সংশয় কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, তাঁদের উদ্দেশে একটিমাত্র কথা বলা যেতে পারে। তাঁর যেন বইয়ের পাতায় নিজেদের সীমাবদ্ধ না-রেখে জীবন ও জগতের অন্তহীন আবহে ঐ কেন্দ্রীয় ভাববীজটির তাৎপর্য সন্ধান করেন। যে-তত্ত্ব জীবনকে উদ্ভাসিত করে না, তা কোনো তত্ত্বই নয়। এই নিরিখে বাখতিন অদ্বিতীয় চিন্তাবিদ নন কেবল, তিনি জীবনের আশ্চর্য অনন্যতার আবিষ্কারক ও ভাষ্যকার। তাঁর ভাবনা আজকের চরম উৎকেন্দ্রিক পৃথিবীতে, আক্ষরিক ও রূপক অর্থে, মনঃপীড়ার আরোগ্য হয়ে আসে। জীবনের সম্ভাবনাকে ধ্বংস-গোধূলিতে আচ্ছন্ন হতে দেন না তিনি, সম্ভাবনার নবায়মান নির্মিতি-বিজ্ঞানই তার অন্বিষ্ট। জীবন নামক পাঠকৃতিতে তিনি খুঁজতে চান নিরবচ্ছিন্ন প্রশ্নমালার যথার্থ উত্থাপন এবং তাদের মীমাংসা-যোগ্যতার বিচিত্র কর্ষণ। সত্তা ও সমাজ-সংস্থার মিথস্ক্রিয়া সর্বদা পূর্ব-নির্ধারিত পথে ঘটে না বলে এদের দ্বিবাচনিকতা সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা চলে না। প্রতিটি ব্যক্তি-অস্তিত্ব ও সামাজিক-অস্তিত্বের উচ্চারণ একই সঙ্গে প্রাগুক্ত মিথস্ক্রিয়ার ফসল এবং অনন্য, স্বাধীন, চূড়ান্ততাহীন। জীবন-সম্পর্কিত বীক্ষণ বাচনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয় বলে উচ্চারণ ও সত্তা বিষয়ক জিজ্ঞাসা অন্যোন্য-সম্পৃক্ত। বাখতিনীয় ভাববিশ্বে মানবিক অস্তিত্ব অফুরান বিস্ময়ের আকর, কেননা তাতে সমাপ্তি বা চূড়ান্তবিন্দু বলে কিছু নেই। সাম্প্রতিক নির্মাণবায়নের প্রেক্ষিতে বাখতিন-ভাবনার গুরুত্ব তাই অসামান্য। যতক্ষণ এই সত্যের উদ্ভাসন না ঘটছে, ততক্ষণ এই অদ্বিতীয় তত্ত্ববিশ্বের প্রকৃত তাৎপর্য অধরা রয়ে যাবে। বাখতিনের চিন্তা-জীবনে প্রারম্ভিক পর্যায় ও পরিণত পর্যায় অনেক সময় জটিলতা তৈরি করলেও কিছু কিছু কেন্দ্রীয় ভাবকল্প সম্পর্কে আগাগোড়া সচেতন থাকতে হয়। এদের মধ্যে অন্যতম হল জীবনকে চিরনির্মীয়মান প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করার তাগিদ। বিশ্বাস নয় কেবল, সংহত চর্যার কথাও বলতে চান এই জীবন-তাত্ত্বিক: আমাদের পৃথিবীতে কখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয় না। জগতের কোনো কথাই শেষ কথা নয়; বস্তুত এই পৃথিবী সম্পর্কে চূড়ান্ত কথাটি কেউ বলতে পারে না কখনো। এই জগৎ আমরাই তৈরি করেছি অথচ বারবার তা যেন আমাদের মুঠো থেকে ঝরে যায়। অস্তিত্বের মধ্যে যতটুকু এই পৃথিবীকে বুঝি, তার বাইরে এর কোনো উপস্থিতি নেই কোথাও। এ জগৎ মুক্ত এবং স্বাধীন; বর্তমানের দর্পণে এর প্রতিবিম্ব দেখছি যখন, ততক্ষণে সেই মুহুর্তের অবসান হয়ে গেছে। আসন্ন অথচ অস্থির ভবিষ্যতের পটে সত্তা ও জগৎ বিধৃত যেন। উপলব্ধির সব আয়তন উচ্চারণে ধরা পড়ে না; তবু উচ্চারণের নিরন্তর নির্মাণই মানুষের ভবিতব্য।

 এই বিন্দুতে মনে পড়ে মিশেল ফুকোর The Order of Things বইয়ের একটি মন্তব্য: বস্তুবিশ্বের জ্ঞানে ভাষা সম্পৃক্ত নয় আর, ভাষার সম্পর্ক এখন মুক্তির সঙ্গে (Language is no longer linked to the knowning of things, but to men's freedom)। অর্থাৎ ভাষা আর ভাবের স্বচ্ছ মাধ্যমমাত্র নয়; তারও আছে নিজস্ব জীবন ও বিধিবিন্যাস। বাচনের নিবিড়তা ও সূক্ষ্ম ব্যাপ্তির তাৎপর্য পুনরাবিষ্কার আসলে অস্তিত্ব-জিজ্ঞাসাকে সুসংহত ও প্রণালীবদ্ধ করার জন্যেই আবশ্যিক। এই বক্তব্য-সূত্রে ফুকো অনেকটা পরিমাণে বাখতিনের

৪৪