পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 শৃঙ্খলা ও সীমানার প্রতি অবহিত থেকেও বাচন অনিবার্যভাবে মুক্তিপ্রয়াসী। আমরা যখন কোনো উচ্চারণে মুগ্ধ ও প্রাণিত হই, শুধু কি শব্দগত অর্থ খুজি? না, আমরা খুঁজি প্রতীতি। বক্তা ও শ্রোতা কিংবা সম্বোধক ও সম্বোধিতের নির্দিষ্ট সময় ও পরিসরে ঐ প্রতীতি নির্ধারিত হয়। আবার আমরা তেমন উচ্চারণও খুঁজি, যার প্রতীতি সর্বজনীন ও সর্বকালীন হতে পারে। অর্থাৎ প্রতীতির প্রক্রিয়াও স্বভাবে দ্বিবাচনিক। শব্দ যখন চিহ্নায়কে রূপান্তরিত হয়, স্বতশ্চলভাবে অনেক প্রথাসিদ্ধ বাধ্যবাধকতা নিরাকৃত হয়ে যায়। অন্তর্বৃত দ্বিবাচনিকতার শক্তিতেই বাচন চিহ্নায়িত হতে পারে। স্থিরতা ও নিশ্চয়তার নামে অচলায়তনকে প্রশ্রয় না দিয়ে সার্থক উচ্চারণ নিজের মধ্যে গতি সঞ্চারিত করে এবং সম্ভাব্য গ্রহীতা-সত্তাদের কাছে পৌঁছানোর জন্যে অর্জন করে কেন্দ্রাতিগ প্রবণতা

চার

 এই প্রসঙ্গে বাখতিন/ভোলোশিনোভ রচিত Marxism and the Philosophy of Language বইয়ের বক্তব্য বিশেষ প্রণিধান-যোগ্য। এতে অজস্র সম্ভাব্য প্রসঙ্গের কথা বলা হয়েছে, যাদের বৈচিত্র বিস্ময়কর। কিন্তু তা সত্ত্বেও শব্দের অর্থদ্যোতনা পরিবর্তনে তাদের ক্ষমতা অনন্ত নয়। দু’জন বাচক বা সম্বোধকের স্বাতন্ত্র্যসূচক পরিসরেই শব্দের অর্থপরিবর্তন কার্যকরী হতে পারে। কোনোভাবেই এই ন্যূনতম শর্তটি লঙ্ঘন করা চলে না। একদিকে ব্যাকরণগত প্রণালীবদ্ধ ভাষাবিন্যাস ও তজ্জনিত শব্দার্থের নির্দিষ্টতা এবং অন্যদিকে নির্দিষ্ট নিয়মরহিত প্রেক্ষিতের প্রায় অন্তহীন উপস্থিতি: এই দুইয়ের ব্যবধান অনতিক্রম্য।

 বাখতিন এই ব্যবধান নিরসনের উপায় নিয়ে ভেবেছেন। তার বক্তব্য হলো, শব্দ সর্বদাই সম্বোধিতের প্রতি ধাবমান—‘toward who that addressee might be...each person's inner world and thought has its stabilized social audience that comprises the environment in which reasons, motives, values and so on are fashioned...the word is a two-sided act. It is determined equally by whose word it is and for whom it is meant. As word, it is precisely the product of the reciprocal relationship between speaker and listener, and addresser and addressee. Each act and every word expresses the one in relation to the other.’ (১৯৭৩: ৮৫-৮৬)।

 বাখতিনের এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এতে শাব্দিক বাচনকে চলমান সম্বোধ্যমানতার দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

 সম্বোধকের বাচন গ্রাহকসত্তার উপস্থিতি ছাড়া অকল্পনীয়। সম্ভাব্য কোনো-এক গ্রাহক বা সম্বোধিতের প্রতীতি ছাড়া বাচনের উদ্ভব হতেই পারে না। তার মানে, বাচকের অন্তর্জগৎ যদিবা উদ্ভাসনের সূচনাবিন্দু হয়েও থাকে, স্থিরীকৃত বহির্জগতের অস্তিত্ব না থাকলে ঐ উদ্ভাসন নিরালম্ব হতে বাধ্য। তার মানে উচ্চারণের চাই নিজস্ব সমাজ, বহির্জগতে যার প্রতিষ্ঠা। যুক্তি-লক্ষ্য-মূল্য ইত্যাদি হয়তো অনেকটাই কল্পনা করে নিতে হয়, কিন্তু সেই কল্পনাও বিশিষ্ট এক বাস্তব বা অধিবাস্তব বলে গণ্য হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা হেঁয়ালির মতো শোনায় যদিও, উচ্চারণের পুষ্টি ঘটে এহেন বিপ্রতীপের দ্বিরালাপে। সম্বোধক ও উদ্দিষ্ট সম্বোধিত এই দ্বিরালাপের অংশীদার বলে বাচন কখনো একমাত্রিক হতে পারে না। শব্দ যেখানে পৌঁছাতে চায়, সেই লক্ষ্য সক্রিয়তার গতি ও স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বক্তা ও

৫০