পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। ‘The Architectonics of Answerabiltiy’ বা প্রত্যুত্তরযোগ্যতার নির্মিতিবিজ্ঞান সংক্রান্ত বহুস্বরিক প্রতিবেদনের উৎস এই ক্ষুদ্র নিবন্ধ। প্রতীচ্যের অধিবিদ্যার তিনটি প্রধান শাখা—জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র ও নন্দনতত্ত্ব—তখন বাখতিনের চিন্তায় সমন্বিত হয়ে একটি অভিন্ন তাত্ত্বিক আকরণে বিন্যস্ত হতে শুরু করেছিল। শিল্পের অভিজ্ঞতা ও প্রায়োগিক ক্রিয়াকে কীভাবে অন্যান্য ধরনের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায়—এ বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণী ভাবনার সূত্রপাত হয়েছিল। সমসাময়িক আরো কয়েকজন চিন্তাবিদ তখন জীবনে শিল্পের ভূমিকা নির্ণয় করতে চেষ্টা করেছিলেন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরে বৌদ্ধিক ঘরানাগুলিতে যে বিপুল আলোড়ন ও পুনর্বিবেচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তার সমস্ত অভিঘাত তখনও স্পষ্ট হয়নি। তবে বিভিন্ন চিন্তা-প্রস্থানে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার প্রতিক্রিয়া অস্বীকার করাও সম্ভব হচ্ছিল না। একদিকে পরস্পরের দার্শনিক স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রাখার রক্ষণশীল প্রয়াস এবং অন্যদিকে রূপান্তর-প্রবণ সময়স্বভাবের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা: এর ফলে পারস্পরিক পার্থক্য ও অনন্বয়ের বোধ থেকে বিতর্কও তৈরি হচ্ছিল। প্রকরণবাদীদের সঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক সমালোচকদের বিরোধ কিংবা ভবিষ্যবাদী ও প্রতীকবাদী কবিদের বিতর্ক সমকালীন বৌদ্ধিক প্রেক্ষিতের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল। এই পরিবেশে বাখতিনের চিন্তাজগতে তৈরি হলো নতুন নতুন বাঁক তৈরির প্রবণতা।


দুই

এই নিবন্ধের শুরুতে যে সওয়াল জবাব, পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষ-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছি, সারা জীবন ধরে নানাভাবে তাদের সংরূপ নির্মাণ করে যেতে হয়। কিংবা, বলা ভালো, নির্মিতির উপযোগিতা পর্যায়ে পর্যায়ে পরীক্ষা করে অনবরত পুনর্নির্মাণ করতে হয়। বিশেষত যিনি অস্তিত্ব ও চিন্তাকে মূলত নির্মিতি বলে জানান, তাঁর পক্ষে এই প্রক্রিয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাখতিন এইজন্যে অগ্রণী চিন্তাবিদ্‌দের অন্যতম যে তিনি জীবনের নিয়ত নির্মীয়মাণ প্রতিবেদনে একই ধরনের প্রশ্নমালার জন্যে ভিন্নভিন্ন প্রত্যুত্তর সন্ধানে বিরত হননি কখনও। সত্তা ও অপরতার সম্পর্ক কত ধরনের সমস্যার আকর হতে পারে কিংবা পার্থক্য-প্রতীতির ভিত্তিগত বাস্তবতা থেকে কত বিচিত্রভাবে সমরূপতার উদ্ভব হতে পারে—তা উপলব্ধির জন্যে ভিন্ন-ভিন্ন পদ্ধতি নির্ণয়ে কখনও ক্লান্ত বোধ করেননি তিনি। জীবন মানে নিত্য নবায়মান প্রকল্পের সন্ধান—এই অনুভব থেকে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন জিজ্ঞাসার যথার্থ উপস্থাপনায়। আসলে জিজ্ঞাসার ধরন ও নির্যাস খুব একটা বদলে যায়নি, যদিও প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর ধারণা যথেষ্ট বিবর্তিত হয়েছে। বাখতিনের কাছে সমস্ত প্রত্যুত্তরই মীমাংসা নয়, তবে তেমন সম্ভাবনা জাগিয়ে দেওয়া যে তাঁর অন্বিষ্ট, এ-সম্পর্কে সংশয় নেই কোনো। সম্ভাব্য মীমাংসা বা প্রত্যুত্তরের নির্মিতি-বিজ্ঞান আবিষ্কার করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

 বাখতিনের ভাবনা দার্শনিক মননে উজ্জ্বল যদিও প্রচলিত দর্শন-প্রস্থানগুলির সঙ্গে তাঁর সরাসরি আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার জগৎ ও জীবন

৫৬