পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অস্তিত্বের অন্তহীন পরিসরে সত্তার অনন্যতাই ঐ বিশিষ্ট শূন্যায়তনে বীজাধান করতে পারে। আর, এই বীজতলি থেকে নিরন্তর অঙ্কুরিত হতে থাকে বাস্তব ও সেই বাস্তবের নিরবচ্ছিন্ন প্রতিবেদন। গ্রন্থনা রচিত হয় জিজ্ঞাসার, অনবরত মীমাংসা-প্রয়াসের বিস্তার ঘটবে বলে। যা কিছু ঘটছে ও ঘটতে পারে, তাদের গ্রন্থনায় রচিত হয় অনন্য জগৎ। এই জগতে অজস্র সমান্তরালতার মধ্য দিয়ে কেবলই উঠে আসতে থাকে ঐক্য-প্রতীতির নবায়মান পথরেখা। এতে অংশগ্রহণ করতেই হয় কেননা সত্তা মানে অংশীদার হওয়ার প্রত্যয়। অংশীদার না হয়ে কোনো উদ্যমে কিংবা চেতনায় পৌঁছানো যায় না। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজস্ব জগতের নির্মিতি-বিজ্ঞানের পথিকৃৎ। যতক্ষণ নতুন নতুন জিজ্ঞাসা উত্থাপন না করছি এবং তাদের মীমাংসা-যোগ্যতা নিজেদের অনন্য অস্তিত্বে পরীক্ষা না করছি—বিষয়ীসত্তা ও বিষয়বোধ অনায়ত্ত থেকে যাবে। এ প্রসঙ্গে বাখতিনের অসামান্য দ্যোতনাগর্ভ মন্তব্য স্মরণ করতে পারি: ‘Life can be consciously comprehended only in concrete answerability. A philosophy of life can be only a moral philosophy. Life can be consciously comprehended only as an ongoing event, and not as Being qua a given. A life that has fallen away from answerability cannot have a philosophy: it is, in its very principle, fortuitous and incapable of being rooted.’ (১৯৯৫: ৫৬)।

 বাখতিনের বাচন এখানে দার্শনিক দ্যুতিতে দীপ্যমান। যে-জীবন ঊষর, তাতে কোনো জিজ্ঞাসা থাকে না; অতএব মীমাংসার জন্যে কোনো প্রস্তুতি বা ব্যাকুলতা থাকে না। এই জীবন নিরুদ্যম ও ব্যর্থ, তার শেকড়ে নেই জলের তৃষ্ণা, শাখায়-শাখায় নেই আকাশের প্রত্যাশা। ছিন্নমূল জীবন মীমাংসা-প্রক্রিয়া থেকে বিচ্যুত বলেই তা দর্শনবিহীন নন্দনরহিত। এমন অপ-জীবনের উদ্দেশে প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক উচ্চারণ করেছিলেন ধিক্কার: ‘অসূর্যা নাম তে লোকাঃ অন্ধেন তমসাবৃতাঃ। তাংস্তে প্রেত্যাভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো জনাঃ॥’ অধিবিদ্যাগত অনুষঙ্গ বর্জন করে যদি পুনঃপাঠ করি, আত্মহনন মানে হতে পারে মীমাংসা-যোগ্যতা সম্পর্কে নিস্পৃহ নিরাবেগ নিরেট মানুষের সত্তাবলুপ্তি। আর, তার জন্যেই বরাদ্দ থাকে নিশ্ছিদ্র পারাপারহীন অন্ধকার। এই অপমানুষের উদ্যম নেই, অপরতার অস্তিত্ব সম্পর্কে বোধ নেই। তার এপার-ওপারও নেই; নেই কোনো আরম্ভ কিংবা বিস্তার। জীবনকে সচেতন ভাবে অনুধাবন করতে পারি কেবল চলমান ঘটনা-পরম্পরার নিরিখে, কল্পিত কোনো পরাসত্তার বিভঙ্গ হিসেবে নয়। বাখতিন যখন বলেন, জীবনের দর্শন শুধুমাত্র নৈতিক দর্শন হতে পারে—অস্তিত্বের মর্মমূলে প্রচ্ছন্ন শৃঙ্খলার উপলব্ধির প্রতি তিনি তর্জনি সংকেত করেন। যেহেতু এই বক্তব্যের সঙ্গে তিনি মূর্ত মীমাংসা-যোগ্যতার নিরিখে সচেতন ভাবে জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধির বার্তাকে মিলিয়ে নিয়েছেন—কৃত্য বা উদ্যম, তত্ত্ববীজ বা চিন্তাপ্রণালী শুধুমাত্র সর্বাত্মক আস্তিত্বিক উপলব্ধির ভিন্নভিন্ন স্তর না-হয়ে সম্ভাব্য সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও নৈতিক ইতিহাসের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক আধুনিকোত্তর নির্মাণবায়ন প্রবণতা যখন মানবসত্তার সমস্ত আদিকল্প ও আকল্পকে চরম তাচ্ছিল্য ও ঔদ্ধত্য দিয়ে নিরাকরণ করছে, বাখতিনের প্রাগুক্ত মন্তব্যকে আধিপত্যবাদের উদ্দেশে কার্যকরী প্রতিস্পর্ধা বলে পুনঃপাঠ করতে পারি আজ।

৬২