পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জিজ্ঞাসার সূত্রে তিনি রচনাপ্রক্রিয়া, রচয়িতা ও নায়কসত্তার পার্থক্য, সত্তা ও অপরতার ব্যবধান ইত্যাদি প্রসঙ্গ অবতারণা করেছেন। লেখক/প্রতিবেদক বাখতিনের কাছে কোনো একবাচনিক ও স্থিরীকৃত অস্তিত্ব নয়; কৃত্যের সঞ্চালক হিসেবে তা বিশিষ্ট দক্ষতা ও শক্তির পারিভাষিক নাম। তাই স্রষ্টা-লেখক আর লেখক-ব্যক্তি হুবহু এক হতে পারে না। সত্তার পরিচয় ফুটে ওঠে তার প্রকল্পে; ব্যক্তির জৈবিক অবস্থানের সঙ্গে সত্তাকে পুরোপুরি মেলানো যায় না। তেমনি লেখক-স্রষ্টাও বিশিষ্ট উপস্থিতি; কৃত্যের নিরিখে নির্ণীত হয় তার অভিজ্ঞান। সৃষ্টির প্রক্রিয়া যখন চলমান, সাধারণ অবস্থান থেকে লেখক-সত্তা উন্নীত হয় ‘বিশেষ’ অবস্থানে। নানা ধরনের অন্তর্বৃত ও বহির্বৃত সংঘর্ষ আছে সত্তার। তারই মধ্যে স্রষ্টা-প্রতিবেদকের সংঘর্ষ আরও একটু আলাদা। এই সংঘর্ষ যেমন কৃত্যের হয়ে ওঠায় অনুভূত হয়, তেমনি লক্ষ করা যায় সন্দর্ভে বিভিন্ন কুশীলবের মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোনের উপস্থাপনায়, বিশেষত নায়কসত্তার রচনায়। পাঠকৃতির মধ্যে বিভিন্ন পরিসরের উপস্থিতি ও উচ্চারণের বহুত্ব যে মূলত উপস্থাপিত দৃষ্টিকোনের বহুত্ব—তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্রষ্টা-প্রতিবেদকের সংঘর্ষময় তাৎপর্যসন্ধান এভাবেই পাঠকৃতিকে বহুস্বরিক ও অনেকার্থদ্যোতক করে তোলে।

 বাখতিন লিখছেন: ‘The Artist's struggle to achieve a determinate and stable image of the hero is to a considerable extent a struggle with himself’ (১৯৯৫: ৬)।

 এই বিষয়টি এমন যা সূক্ষ্ম বা সানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ দাবি করে। এখানে যে আত্মগত সংঘর্ষের কথা বলা হয়েছে, ভিন্ন ভিন্ন পাঠকৃতিতে তার অভিব্যক্তিও ভিন্ন ভিন্ন। নায়কসত্তায় থাকে কেন্দ্র ও পরিধির টানাপোড়েন, প্রতিবেদক ও অপরতার আততি। কেননা তার অন্বিষ্ট উপস্থিতিতে লেখকস্বরের অনুপস্থিত অস্তিত্ব কখনো কখনো অনতিক্রম্য। লেখক যেহেতু ‘secret legislator of the text’ (১৯৮৪: ৮৯), নায়কসত্তার সার্বভৌমত্ব শুধুই প্রতীয়মান। তবে যখন উত্তমপুরুষ কথকের বয়ানে ঐ সত্তা উপস্থাপিত, প্রত্যুত্তরযোগ্যতা ও নির্মিতি-বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ নানাভাবে রূপান্তরিত হতে বাধ্য। বাঙালি পাঠকের কাছে রজনী, চতুরঙ্গ, জাগরী, বিবর কিংবা কঙ্কাবতী, পথের পাঁচালী, অন্তঃশীলা, কাঁদো নদী কাঁদো, হারবার্ট, খোয়াবনামা অথবা বিষবৃক্ষ, গোরা, ঘরে-বাইরে, পুতুল নাচের ইতিকথা, গণদেবতা, অন্তর্জলী যাত্রা, অরণ্যের অধিকার প্রভৃতি উপন্যাসে লেখকসত্তা-নায়কসত্তা-কথকসত্তার দ্বিবাচনিক নির্যাস যেভাবে ধরা পড়ে, তা নিবিড় বিশ্লেষণের বিষয়। বাখতিনীয় আকল্প অনুযায়ী প্রাগুক্ত সত্তাগুলির আন্তঃসম্পর্ক ঐসব উপন্যাসে নানা ধরনের জিজ্ঞাসার সমান্তরালতা ও অজস্র মীমাংসা-প্রয়াসে দেখতে পাই। এইসব সত্তার অভিব্যক্তিতে যত বিভঙ্গ লক্ষ করি, সেইসব অন্তঃস্বরের সমারোহ সম্পর্কে অবহিত করে আমাদের। এই সমারোহে চূড়ান্ত মীমাংসা নেই, আছে শুধু মীমাংসা-প্রয়াসের নিরবচ্ছিন্ন আর্তি। নির্মিতির বিবিধ বর্গ হিসেবে এইসব মূলত সত্তা ও অপরতার মৌল পার্থক্য ও সমান্তরালতার যুগলবন্দি। ঐ প্রত্যয়ের নানা অভিব্যক্তি শেষ পর্যন্ত জেগে থাকে কেবল ‘architectonics of consciousness.’ (তদেব, ৯৪)-এর চূড়ান্তহীন বিচ্ছুরণ নিয়ে।

৬৬