পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তত্ত্ববিশ্ব, মার্ক্সীয় প্রেক্ষণে

প্রতিটি উচ্চারণ মূলত সামাজিক ক্রিয়া আর কোনো অস্তিত্বই কখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়—এমন কথা যিনি বলেন, তাঁর প্রতিবেদনে বৌদ্ধিক বিদ্যুচ্চমক থাকে না কেবল। থাকে চেতনার সমাজতত্ত্ব সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ও, একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাছাড়া চেতনা মানে অপরতা যাঁর কাছে, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর যাবতীয় প্রতিবেদনে থাকবে মাটি ও আকাশের দ্বিবাচনিক বিনিময়—এও প্রত্যাশিত। তিনি, মিখায়েল মিখায়েলোভিচ বাখতিন, নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে প্রত্যক্ষ জেনেছেন প্রতীয়মান বাস্তবের মধ্যে অজস্র সমান্তরাল বাস্তবের অস্তিত্ব। জেনেছেন, জীবনের প্রতিবেদন কখনো একটিমাত্র স্বরের বিন্যাস নয়; স্বর থেকে স্বরান্তরে যেতে যেতে নানা উচ্চাবচতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে সুরসংহতি, সমবায়ী উচ্চারণের সামাজিক প্রত্যয়। জীবনের তাৎপর্য সম্পর্কে যে দার্শনিক বীক্ষা বাখতিন প্রস্তাব করেছেন, তাতে দেখি, কোনো তাৎপর্য পুরোপুরি হারিয়ে যায় না কখনো। একদিন না একদিন নতুন প্রতীতি, নতুন উপলব্ধির আকরণ নিয়ে ফিরে আসে। তাঁর মতে, এ যেন নীড়ে-ফেরার উৎসব। বৃন্তহীন পুষ্পের মতো কোনো কিছু বিকশিত হতে পারে, একথা বাখতিন মানেন না। তিনি যখন বলেন, প্রতিটি সত্তা সহযোগী সত্তা আর জীবন মানে সত্তার সহযোগিতার নিরন্তর ঘটনা-পরম্পরা এবং সংগঠন—সেসময় তাঁর সামাজিক প্রেক্ষণের আদল স্পষ্ট হয়ে ওঠে আরো। রাবেলে ও তাঁর জগৎ বইতে বাখতিন এই প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন, যে, হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শেষ হয় না কখনো, সম্পূর্ণ হয় না পরিধি। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তা গড়ে ওঠে, মুখর হয় নতুন সৃষ্টিতে। এক পরিধি থেকে অনবরত তৈরি হতে থাকে আরেক পরিধি। এই সংগঠন একদিকে শুষে নেয় জগৎকে, আবার অন্যদিকে জগৎও শুষে নেয় সত্তার সংগঠনকে। জীবনের সূচনা ও সমাপ্তি নিবিড়ভাবে পরস্পর-সম্পর্কিত এবং অন্তর্বয়নের সূত্রে অন্যোন্য-সম্পৃক্ত।

 অস্তিত্বের প্রতিটি স্তরে ভিন্ন-ভিন্ন পদ্ধতিতে চলেছে দ্বিরালাপ। সত্তার সংগঠনে জাগতিক অনুপুঙ্খগুলির দ্বিবাচনিক বিনিময় থেকে একই সঙ্গে ফুটে উঠছে ঐক্য ও অনৈক্য, সঙ্গতি ও বিসঙ্গতি। মানবিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বাচনই প্রকাশের ভিত্তি—একথা না লিখলেও চলে। ভাষার মধ্য দিয়ে জীবন ও জগতের সঙ্গে অহরহ যে-সম্পর্ক গড়ে তুলছি, বাচনের মধ্যে তার স্পষ্ট আদল ফুটে ওঠে। এই বাচন হয় দুইয়ের মধ্যে; নিজে-নিজে তা কখনো ব্যক্ত হতে পারে না। অপর অস্তিত্ব দর্পণের মতো সত্তাকে প্রতিফলিত করে; কিংবা প্রতিফলিত-ই করে না কেবল, একে অপরকে প্রমাণিতও করে। অপরের ধারণা না-থাকলে সত্তার প্রতীতিও অসম্ভব। প্রতিদিনের সামাজিক ব্যবহারে সংলাপের মধ্য দিয়ে যেমন একে অপরের কাছে উন্মোচিত হই এবং সেই সূত্রে জগৎ ও জীবনের তাৎপর্য পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করি, যাচাই করে নিই—তেমনি এই সংলাপের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে আমাদের কথনবিশ্ব। বাখতিন এই অতিপরিচিত ব্যবহারিক অনুপুঙ্খকে পারিভাষিক মর্যাদা দেননি কেবল, একে তাঁর তত্ত্ববিশ্বের মুখ্য আকল্প করে তুলেছেন।

৬৭