পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দু’জন মানুষের সংলাপে কথক ও শ্রোতার কথা বলা ও কথা শোনার মধ্যে বিনিময়ের সেতু গড়ে ওঠে। দুজনের সমান্তরাল অস্তিত্ব তাতে স্বীকৃত হচ্ছে যেমন, তেমনি দুইয়ের অবস্থানগত পার্থক্যও স্পষ্ট। স্বভাবত তাদের উচ্চারণও পরস্পর থেকে আলাদা হবে। দেরিদা যাকে ‘পার্থক্য-প্রতীতি’ বলেন, বাখতিনও সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন। সংলাপের পারিভাষিক রূপান্তরের ফলে যা হয়ে উঠল দ্বিবাচনিকতার দার্শনিক ভূমি, তাতে বিনিময়ের গভীরতর বিচ্ছুরণ থেকে নানা ধরনের সম্ভাবনার উপকূলরেখা জেগে উঠেছে। এইসব সম্ভাবনার মধ্যে চলেছে আন্তঃসম্পর্কের বিন্যাস যাকে বাখতিন ‘mutuality of differences’ বলতে চেয়েছেন। নিরবচ্ছিন্ন বিন্যাসের মধ্য দিয়ে বিপুল সমগ্রের আয়তনে পৌঁছাতে হয় বলে কোনো একক সত্তার আধারে তাকে সম্পূর্ণ ধারণ করা অসম্ভব। সত্তা ও অপরতার সম্পর্ক বারবার ছেদহীন নির্মাণের প্রক্রিয়ায় যখন গৃহীত ও পুনর্গৃহীত হয়—কেবলমাত্র তখনই তাৎপর্যের দ্বিবাচনিক গ্রন্থনা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

 এই যে গ্রন্থনার কথা বলছি, ধারাবাহিক বিনিময়ের ভিত্তিতে তা গড়ে ওঠে। স্বভাবত তাৎপর্যও একাত্তিক নয়, অনেকান্তিক। অপরতার উপলব্ধি ছাড়া চেতনা যেহেতু অপ্রতিষ্ঠ, সত্তা কখনো স্বনির্ভর প্রকল্প নয়। জীবন ও জগতের সমস্ত অনুপুঙ্খের মতো অস্তিত্বও আসলে এক নির্মিতি; কিন্তু তা নিজে-নিজে পূর্ণ হয়ে ওঠে না। কেন্দ্র ও পরিধির টানাপোড়েনে ব্যক্ত পার্থক্যভিত্তিক সম্পর্ক অর্থাৎ সম্পর্কের দ্বিবাচনিকতা ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিসরকে অনবরত নির্মাণ করে চলেছে। বাখতিন মনে করেন এই পার্থক্য যেমন আপেক্ষিক তেমনি দীর্ঘায়ত। দ্বিবাচনিক দর্শন অনুযায়ী তাই সমস্ত তাৎপর্য আপেক্ষিক এবং প্রতিবেদনের উপসংহার আসলে আপাত-সমাপ্তি। পরবর্তী কালে ও পরিসরে তাৎপর্য পুনর্নবায়িত হয় বলে মুক্ত উপসংহারের প্রতীতি সাম্প্রতিক তত্ত্ববিশ্বে এত গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যিক সন্দর্ভে, নান্দনিক প্রেক্ষিতে, সামাজিক চর্যায় রাজনৈতিক প্রতিবেদনে এই সত্যই সমর্থিত হচ্ছে বারবার। বাখতিন জানিয়েছেন, অস্তিত্বে অন্তর্বৃত পার্থক্য দূর করা যায় না কখনো কেননা ‘Separateness and simultaneity are basic conditions of existence’ (১৯৯০: ২০)। ধারাবাহিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে কোনো-একটি ঐতিহাসিক পর্যায়ের তাৎপর্য যখন অন্য আরেকটি পর্যায়ে পৌঁছে যায়, ঐ প্রক্রিয়ায় দুটি স্তর যুগপৎ সত্য হয়েও পৃথক পরিসরে বিরাজ করে। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ও দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বাখতিনের ভাববিশ্বে পুনর্নির্মিত হয়েছে। আইনস্টাইনের মতো বাখতিনও পর্যবেক্ষকের অবস্থানকে মৌলিক বলে ভেবেছেন, কারণ, আন্তঃসম্পর্কের তাৎপর্যে দ্বিবাচনিক বিন্যাস যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ঐ সম্পর্কে উপলব্ধির জন্যেও চাই উপযুক্ত প্রেক্ষণবিন্দু। সমান্তরালতার সম্পর্ক বিন্যাসে ঐ পর্যবেক্ষকও নিরাসক্ত দ্রষ্টা নন, সক্রিয় সহযোগী। তার মানে, তিনি যেমন পর্যবেক্ষণ করেন, তেমনই নির্মীয়মান সন্দর্ভের অংশভাক হয়ে নিজেও তাৎপর্য উপপত্তির অন্যতম প্রকরণ হয়ে ওঠেন। সুতরাং দ্বিবাচনিক পদ্ধতিতে সত্তা এবং সত্যের প্রতীতি থেকে আমরা এই বুঝি যে, বাস্তবতার নিষ্কর্ষ কেবলমাত্র পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে না। তাকে সর্বদা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। আর, এই অর্জন সম্ভব কেবল নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে: ‘Everything is perceived from a unique position in existence’ (তদেব: ২১)।

 যখন একথা বলি, মার্ক্সীয় প্রেক্ষণের সঙ্গে এই ভাবনার সাযুজ্য চোখে পড়ে। কারণ

৬৮