পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

‘নির্দিষ্ট অবস্থান’ আর কিছুই নয়, ভাবাদর্শগত অবস্থান। আধিপত্যবাদী বর্গের স্থিতি যখন বিনা দ্বিধায় মেনে নিই, প্রতাপের ভাবাদর্শ আমাদের মধ্য দিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক আর সোনার পাথরবাটি একই কথা। ইতিহাসের মানুষ হিসেবে যখন ঐতিহাসিক সন্দর্ভে হস্তক্ষেপ করি, নিজেদের ইতিহাস নিজেরাই গড়ে তুলি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে ভাবাদর্শের উপযোগিতা পরখ করে না-নেওয়া পর্যন্ত সত্যের স্ফুরন হতে পারে না। ব্যক্তিসত্তা ও সামাজিক সত্তার মধ্যে পার্থক্য ও সমান্তরালতার দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়াকে বুঝি কেবল ভাবাদর্শগত প্রেক্ষণবিন্দু থেকে। সুতরাং বাখতিনের কাছে যদি এই পাঠ নিই যে সত্তা হলো আকরণযুক্ত ঘটনার অন্য নাম এবং সত্তার আকরণ বিন্যস্ত হতে পারে কেবল সময় ও পরিসরের বর্গায়তনে—তাহলে বুঝতে পারি, মার্ক্সবাদ প্রস্তাবিত দ্বন্দ্বমূলক দর্শন এবং বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ার প্রায়োগিক উপলব্ধির নির্যাস এই ভাবনায় উপস্থিত। অপরতার প্রেক্ষিত ছাড়া ব্যক্তিগত বা সামাজিক বা ঐতিহাসিক সত্য নিরূপিত হতে পারে না। এই বাখতিনীয় আকল্পের সঙ্গে মার্ক্সীয় তাৎপর্যবাদের আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। তিনি বলেছেন, ‘There is no figure without a ground’: তদেব: ২২)। আরো বলেছেন, মানুষের মনের কাঠামোটা এরকম যে জগৎকে বিপ্রতীপ দর্পণে না-দেখা পর্যন্ত অর্থপ্রতীতি হয় না। মার্ক্সবাদও প্রসঙ্গ বিচ্যুত সত্যের অস্তিত্ব স্বীকার করে না; জানে যে সত্য অচল অনড় নয় বলেই পরিস্থিতি অনুযায়ী তার রূপান্তর হয়। এই পরিস্থিতি নিছক যান্ত্রিক অবস্থান নয়, ইতিহাসনিয়ন্ত্রিত ভাবাদর্শ এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। অজস্র দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়ে চলেছে জীবন। মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক ইয়ুরি খারিন লিখেছেন, ‘The world is not a chaotic agglomeration of isolated things but an integral totality of interacting phenomena. The relations between objects and their properties, manifested in their mutual determinacy, conditionallity and dependency, are expressed in the concept of connection.’ (১৯৮১: ১১১)। এই বক্তব্য থেকে বাখতিনের ভাববিশ্ব খুব বেশি দূরে নয় নিশ্চয়।

 বাখতিনের অন্যতম প্রধান আকল্প হলো, যেসব ক্রিয়া আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে পারে এবং সামাজিক সংযোগের সেতু গড়তে পারে—শুধুমাত্র তাদেরই রয়েছে তাৎপর্য বহনের যোগ্যতা। নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ ও পরিস্থিতি তাদের প্রেরণা দেয় ও শক্তিমান করে তোলে। মানুষের জীবন, চিন্তা এবং উচ্চারণ: সমস্তই যেন বহুস্বরিক সংযোগ ক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন আয়তন। অর্থোপপত্তি যা-থেকে হয় না, তার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে এমনও হতে পারে যে, সাধারণ প্রচলিত পরিধির মধ্যে তাৎপর্য-প্রতীতি হলো না। সেক্ষেত্রে পরিধি-বহির্ভূত কোনো প্রেক্ষণবিন্দু থেকে অর্থবোধ হওয়া সম্ভব। এও আসলে অপরতার দর্শন। যেমন, ধরা যাক, ব্যক্তিগত পর্যায়ে কারো জীবনের নিষ্কর্ষ চূড়ান্তভাবে বুঝতে পারি যখন মৃত্যুর দর্পণে ঐ জীবনবৃত্তকে প্রতিফলিত হতে দেখি। তেমনি কোনো সমাজে একটি পর্যায় যখন শেষ হয়, সেসময় ঐ পরিসরের বাইরে গিয়ে তার যথার্থ পরিমাপ করতে পারি। সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রতিবিপ্লব ঘটে যাওয়ার পরে যেমন এখন বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার আলো ছায়ার অর্থোপপত্তি হচ্ছে। এখানেও অবশ্য পর্যবেক্ষকের

৬৯