পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দুই

একটি বিখ্যাত চীনা প্রবাদে এই শুভেচ্ছা প্রকাশ করা হয়: ‘তোমাদের কাউকে যেন গুরুত্বপূর্ণ বা ঘটনাবহুল বা আগ্রহোদ্দীপক সময়ে বাঁচতে না হয়।’ তাহলে, ঝড়ের মুখে কুটোর মতো বা ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে নৌকোর মতো তাকে হারিয়ে যেতে হবে—এই হলো মোদ্দা আশঙ্কা। মিখায়েল বাখতিনের মতো আর ক’জন চিন্তাবিদকে এত বেশি ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে বাঁচতে হয়েছিল, তা বলা কঠিন। ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যখন রুশ সমাজে ইতিহাসের রৈখিকতা ভেঙে দিচ্ছিল, তখন বাখতিন বাইশ বছরের তরুণ। বিপ্লবের আগে এবং পরে দ্বিধা-সংশয়-প্রত্যয়ের দোলাচল এবং ঘাত-প্রতিঘাত তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে শুষে নিয়েছিলেন। লেনিনের গঠনমূলক নেতৃত্ব থেকে স্ট্যালিনের একান্তিক নেতৃত্বে বিবর্তন এবং তার সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য তিনি পর্যবেক্ষণ করেননি কেবল, তাঁকে ভুক্তভোগীও হতে হয়েছিল। তাঁর আকল্প অনুযায়ী বলা যায়, যুগান্তকারী ইতিহাসের অনিবার্য তাড়নায় তাঁকে নিতে হয়েছিল সক্রিয় পর্যবেক্ষকের ভূমিকা। তিনি গৃহযুদ্ধ দেখেছেন, নাজি আক্রমণের ভয়াবহতা দেখেছেন। বিপ্লবোত্তর কালে তরুণ বুদ্ধিজীবীদের নতুন জীবনস্বপ্ন ও উৎসাহের উত্তাপ অনুভব করেছেন এবং ত্রিশের দশকে স্বপ্নভঙ্গের শৈত্য, মতান্ধতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসও প্রত্যক্ষ করেছেন। ফ্যাসিবাদ দেখেছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিরোধও দেখেছেন; হিমযুদ্ধের আমলে সাংস্কৃতিক অবসাদ, ক্রুশ্চেভ জমানার সংশোধনবাদ, ব্রেজনেভ পর্বের আদর্শচ্যুতি—একাদিক্রমে এই সব কিছুর মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার এমন অভাবনীয় ভাবে যাঁর কাছে উন্মুক্ত হতে পারে, তিনি তো গভীর অনুভূতি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন দ্বিবাচনিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব লক্ষ করবেন সমাজে-ইতিহাসে। বহ্নিমান সময়পর্বে যিনি ভেবেছেন এবং লিখেছেন, তাঁকে কেবল ব্যক্তি-সত্তা হিসেবে বিবেচনা করলে ভুল হবে। তিনি আসলে সময়-প্রতীকী অস্তিত্ব; ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে তাঁর নিরন্তর সংগঠিত দ্বিবাচনিক সম্পর্ক স্বতঃসিদ্ধ। জীবন ও মনন অন্যোন্যসম্পৃক্ত তাঁর; আধুনিকোত্তরবাদের পক্ষে এক্ষেত্রে বাখতিন প্রভূত সমস্যার কারণ। শৈশব ও কৈশোরের অভিজ্ঞতা তাঁকে বহুভাষায় পারঙ্গম করে তুলেছিল; আর পরবর্তী পর্যায়ের ঘটনা-প্রবাহ থেকে তিনি অর্জন করেছিলেন বহুস্বরিকতার অস্খলিত প্রত্যয়।

 ১৯১৮ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত নেভেল ও ভিটেব্‌স্ক শহরে এবং ১৯২৪ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত লেনিনগ্রাদে বাখতিন যে নিবিড় বৌদ্ধিক মিথষ্ক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন—কার্যত তাই তাঁর চিন্তাবিশ্বের গোড়াপত্তন করেছে। তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই তখন মার্ক্সবাদী ভাবপ্রকরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসু এবং পরবর্তী স্ট্যালিন-আমলের মতো মতান্ধতা না-থাকাতে সব বিষয়ে তর্কবিতর্কে তাঁরা আগ্রহী। একদিকে ধর্ম ও দর্শন, অন্যদিকে ভাষাতত্ত্ব-মনস্তত্ত্ব-সমাজতত্ত্ব-সাহিত্যতত্ত্ব—সব কিছুকে তাঁরা অণুবীক্ষণের বিষয় করে তুলেছিলেন। কোনো সংশয় নেই যে ব্যবহারিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বাখতিন তাঁর তত্ত্ববিশ্বের অন্যতম প্রধান আকল্পে পৌঁছেছিলেন: প্রতিটি সত্তা সহযোগী সত্তা এবং কোনো কিছু স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। চেতনা মানে যে অপরতার উপলব্ধি এবং সত্তা হলো আসলে এক নির্মিতি—এই বিশ্বাস তাঁর মনে দৃঢ়মূল হয়েছিল অবশ্যই এই পর্বে। জীবনের

৭১