পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 চিন্তাজীবনের শুরুতেও তাহলে বাখতিন চেতনাকে একান্তিক বলে ভাবতে চাননি। অপরতার দার্শনিক, নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, নান্দনিক ব্যঞ্জনাকে স্তরে-স্তরে গঠন করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ধান তখন থেকেই আবশ্যিক নৈতিক মান্যতা অর্জন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অপর ব্যক্তিদের অপরতার স্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্বকে মর্যাদা দিতে হবে—এই হলো বাখতিনের মৌল বার্তা। সোভিয়েত সমাজের রাজনৈতিক পুনর্গঠনে আলোর সঙ্গে ছায়াঞ্চলও যে প্রসারিত হচ্ছিল, তা অনুভব করেই কি তিনি গভীর সংবেদনশীলতা দিয়ে মানবস্বরূপের সম্পূর্ণ পরিসর প্রতিষ্ঠার উপায়ের দিকে তর্জনি সংকেত করলেন? এবিষয়ে সার্থক আলোচনা এখনই হতে পারে যেহতু মৃত্যুর দর্পণে তাঁর সমগ্র জীবনের কৃতি ও চিন্তার বিবর্তন প্রতিফলিত হচ্ছে। বাখতিনের জীবনবৃত্তের ভেতর থেকে নয়, বাইরে দাঁড়িয়ে তাৎপর্য অর্জনের বহুস্বরিক প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করতে পারছি। ভোলোশিনোভ ও মেডভেডেভের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সূত্রে গ্রথিত বাখতিনের চিন্তাজীবনে সময় ও পরিসরের পর্যায়ক্রম কীভাবে ব্যক্ত হয়েছে, তা পর্যালোচনা করে যেমন তাৎপর্য-সন্ধানের তাৎপর্য বুঝতে পারি, তেমনি মার্ক্সীয় প্রেক্ষণের প্রাসঙ্গিকতাও অনুভব করি। এখানে বলা প্রয়োজন, ১৯৭০ সালে রুশ ভাষাবিদ ভিয়াচেশ্লাভ ইভানভ প্রথম ভোলোশিনোভ ও মেডভেভেভ রচিত বইগুলিকে বাখতিনের লেখা বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। এবিষয়ে বিতর্ক এখনো অব্যাহত। তবু বাখতিনের মুখ্য আকল্প অনুযায়ী সমকালীন সমাজের প্রধান উচ্চারণ হিসেবে মার্ক্সবাদী ভাবনাপ্রস্থানের সঙ্গে অন্য সব উচ্চারণের দ্বিবাচনিক বয়নকে আমরা নিশ্চয়ই উপযুক্ত মর্যাদা দেব। এই সূত্রে প্রাগুক্ত প্রতিবেদনগুলিকে বাখতিনের নির্মীয়মান চিন্তাবিশ্বের বহুস্বরিকতার অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে বাধা নেই কোনো। তাছাড়া অভিন্ন চিন্তাবৃত্তের শরিকদের মধ্যে দশকব্যাপী ঘনিষ্ঠ বিনিময় যখন ঐক্যবোধকে গড়ে তুলেছিল, তখনও বাখতিনের বৌদ্ধিক অস্তিত্বই যে ছিল কেন্দ্রীয় সংবেদনার আকর—এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি। তাৎপর্যের মতো তাৎপর্যধারকও তো মূলত সামাজিক সত্তা; অতএব ভোলোশিনোভ/মেডভেডেভ-কে বাখতিন নামক সূত্রধার-অস্তিত্বের নির্ভরতাদায়ী দ্বিবাচনিক অপর হিসেবে গ্রহণ করতে বাধা নেই কিছু। মুক্ত ভাবনার পরিসরকে যতটা বেশি সম্ভব নির্বিঘ্ন রাখার প্রয়োজনেই সম্ভবত বাখতিন প্রতিকল্প সত্তার আড়ালে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখেছিলেন। দ্বিরালাপের মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছাই সমবায়ী সত্যের উপকূলে, এই সংকেত দেওয়ার জন্যেই যেন ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিজস্ব লেখকসত্তার সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে নিয়েছিলেন তিনি।


তিন

১৯২৯ সালে বাখতিনের চিন্তাজীবনের প্রথম পর্যায় সমাপ্ত হলো। ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সঙ্গে যৌথ নির্মাণের বদলে এবার তাঁকে এগিয়ে যেতে হলো একক পরিক্রমায়। অবশ্য এই আপাত-সঙ্গহীনতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে বহুস্বরসঙ্গতির উপার্জনও। মার্ক্সীয় প্রেক্ষণ এই পর্যায় থেকে মঞ্চসাজের আড়ালে চলে যাবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে দ্রুত এমন কিছু ঘটনা ঘটবে, যা ব্যক্তি-বাখতিন ও চিন্তাবিদ বাখতিনের দ্বিবাচনিক গ্রন্থনায় বিচিত্র উচ্চাবচতা ও তীক্ষ্ণ জটিলতা যুক্ত করবে। লেনিন-পরবর্তী রাশিয়ায়

৭৩