পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সমাজতন্ত্রের অন্ধকার অপর অবয়বটি ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়েছে। রাষ্ট্রকে ভাবাদর্শগত অন্তর্ঘাত থেকে রক্ষার প্রয়োজনে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিকল্পিত হয়েছিল। কিন্তু যৌথ কর্মোদ্যোগে ব্যক্তির ‘স্বাধীন’ অবস্থানের দার্শনিক, রাজনৈতিক ও প্রায়োগিক তাৎপর্য কতখানি—এবিষয়ে যথার্থ পরিশীলিত উপলব্ধি না-থাকাতে অচলায়তনের দুর্লক্ষণগুলি প্রকট হতে শুরু করল। লেনিনগ্রাদে ধর্মজিজ্ঞাসুদের মধ্যে যেহেতু সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ কোনো গুরুত্ব পায়নি, ভেতরে ও বাইরে অসংখ্য শত্রুর মোকাবিলায় ক্লান্ত প্রশাসন এদের সংশয়ের চোখে দেখত। সুতরাং ইতিহাসের অনিবার্য নিষ্ঠুর কৌতুকে নির্দিষ্ট জীবিকাহীন বাখতিন ঐ সংশয়ের শিকার হয়ে পড়লেন। তরুণ চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যমণি হিসেবে তাঁর সঙ্গে তখনকার বিভিন্ন ভাবমণ্ডলীর নিয়মিত যোগযোগ ছিল। জীবনকে যিনি তত্ত্বের প্রায়োগিক অভিব্যক্তি বলে জানেন এবং তাৎপর্যের বহুস্বরিকতায় যাঁর অখণ্ড বিশ্বাস—তাঁর পক্ষে এই যোগাযোগ খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এর মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে বাখতিনের মতো মুক্তমতি মানুষ কোনো গোপন ধর্মীয় প্রেরণা দ্বারা চালিত হয়েছিলেন। জীবন যাঁর কাছে অন্তহীন অনাবিষ্কৃত পরিসরের বিস্তার, জীবনাতিরিক্ত পরাপাঠ দ্বারা তাঁকে উদ্বুদ্ধ মনে করলে বুঝতে হবে যে তাঁর তত্ত্ববিশ্বের নির্যাস আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। সাম্প্রতিক প্রতীচ্যের কোনো-কোনো ব্যাখ্যাতা বাখতিনের কৃতি থেকে মার্ক্সীয় প্রেক্ষণের ক্ষীণতম ইশারাও মুছে ফেলতে ব্যগ্র বলে অতিসরলীকরণ করেন। এটা কম কৌতুককর নয় যে ঠিক বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে তৎকালীন রুশ-প্রশাসন বাখতিনের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ বিকৃতির অভিযোগ তুলে ধরেছিল, তার মানে দুটি দ্বিমেরুবিষম দৃষ্টিকোন থেকে বাখতিনের তাত্ত্বিক অণুবিশ্ব আক্রান্ত, অন্তত কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি।

 ১৯২৯ এল সার্বিক পর্বান্তরের আভাস নিয়ে। সবচেয়ে দুরূহ পরীক্ষা বাখতিনকে দিতে হয়েছিল নিজেরই কাছে। একদিকে ডস্টয়েভস্কির নন্দন বিষয়ে তাঁর বই বেরোচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পীড়নের শিকার হচ্ছেন তিনি। নির্দিষ্ট জীবিকার অভাবে তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থান ছিল না, সুতরাং মননের ক্ষেত্রে কোনো দৃশ্য বা অদৃশ্য শেকলের বাধ্যবাধকতা থেকে তিনি পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন। জীবন ও জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত যা-কিছু মানবিক, বাখতিন সে-সমস্তকে বিশ্লেষণী পর্যবেক্ষণের বিষয় করে তুলেছিলেন। লক্ষণীয় ভাবে, লেনিনের সংকেত অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির সৌধ গড়ে উঠতে পারে কেবল মানবিক উত্তরাধিকারের প্রতি সম্মান দেখিয়ে: ‘We must take the entire culture that capitalism left behind and build socialism with it. We must take all its science, technology, knowledge and art. Without these all be unable to build communist society.’ এই যে ‘সমগ্র সংস্কৃতি গ্রহণ করা’র কথা বলেছেন লেনিন, বাখতিন তাঁর স্বতন্ত্র পথে এই নীতিই মেনে চলেছেন। এই হলো তাঁর বিখ্যাত পারিভাষিক সূত্র ‘heteroglossia’ বা অনেকার্থদ্যোতনার ভিত্তি। কিন্তু লেনিন-পরবর্তী রাশিয়ায় মতান্ধতা সমাজতান্ত্রিক চেতনার মৌল ঔদার্যকে হনন করেছিল। প্রতিটি পরবর্তী যুগ দ্বন্দ্ববাদের ভিত্তিতে যথাপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক উপকরণকে কিছুটা গ্রহণ কিছুটা বর্জন কিছুটা পরিমার্জন করে। সেই সঙ্গে পরীক্ষা, পরিশীলন এবং সংযোজনের মধ্য দিয়ে তার প্রায়োগিক যথার্থতা যাচাই করে নেয়। এই মার্ক্সীয় আকল্প

৭৪