পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

থেকে বাখতিনের বহুস্বরিক তাৎপর্যের সন্ধান খুব দূরবর্তী নয় নিশ্চয়। সোভিয়েত তাত্ত্বিক ই. বালের লিখেছেন: ‘In every new historical epoch humanity always critically evaluates, supplements, develops and enrichs its inherited cultural values in the light of the new opportunities and new objectives standing before society and in accordance with the requirements of the specific social forces.’ (Communism and Cultural Heritage: Moscow: 1984: 66).

 এই বক্তব্যের মধ্যে যে-সূত্রগুলি রয়েছে (সর্বদা বিশ্লেষণী মূল্যায়ন, সংযোজন, বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটানো)—এর প্রতিটি স্পষ্টত বাখতিন সম্পর্কেও প্রাসঙ্গিক। সবচেয়ে বড়ো কথা, প্রতিটি সত্তাকে তিনি সহযোগিতার আধার ও আধেয় বলে জানতেন এবং তাৎপর্যকে সামাজিক গ্রন্থনা ও সম্ভাবনা বলে ভাবতেন। এতে মার্ক্সীয় চেতনারই নির্যাস উপস্থিত। যান্ত্রিকভাবে সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শকে অনুসরণ করার অর্থ মান্যতার ছদ্মবেশে তাতে অন্তর্ঘাত করা। বাখতিন সারা জীবন এই যান্ত্রিকতার বিরোধিতা করে গেছেন। ইতিহাসের নিষ্ঠুর কৌতুকে ত্রিশের দশকে এই যান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের মতান্ধতা তাঁকে মূল স্রোত থেকে নির্বাসন দিয়ে ‘প্রত্যাখ্যাত অপর’-এর অভিধা আরোপ করেছে। অথচ স্বয়ং লেনিন জানিয়েছিলেন, ‘guarding the heritage does not mean confining oneself to the heritage,’ (Collected works: Vol 2: 1977:526), এই চমৎকার সূত্রটি বিস্মৃত হয়েছিল তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের অত্যুৎসাহীরা, রাষ্ট্রীয় প্রতাপের ধ্বজ বহন করে এরা লেনিনীয় আকল্পটি উপেক্ষা করেছিল। অথচ এই একই সূত্র অনুযায়ী, বাখতিন সূক্ষ্ম ও গভীর সংবেদনশীলতা দিয়ে মার্ক্সীয় প্রেক্ষণেরই ধারাবাহিক বিকাশ ঘটিয়ে গেছেন। অপ্রাতিষ্ঠানিক জীবনচর্যা ছিল তাঁর মননের শক্তি ও লাবণ্যের উৎস। তা যদি না হত, রাষ্ট্রীয় পীড়ন তাঁকে স্তব্ধ করে দিতে পারত; অন্তত বহুমাত্রিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিত নিশ্চয়। ১৯৩০-এর শুরুতে লেনিনগ্রাদ ছেড়ে তাঁকে পাড়ি দিতে হলো কাজাখস্তানের অন্তর্গত কুস্তানাই শহরের অন্তরীণ-জীবনে। বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী লুনাচারস্কি যদি ডস্টয়েভস্কি বিষয়ক বইয়ের ইতিবাচক সমালোচনা না করতেন এবং ম্যাক্সিম গোর্কির পত্নী সহ আরো কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী চেষ্টা না করতেন, তাহলে কাজাখস্তানের বদলে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন ভোগ করতে হতে বাখতিনকে। সেক্ষেত্রে তিনি হারিয়ে যেতেন অস্তগোধূলির ওপারে এবং মানুষের তত্ত্ববিশ্বও কখনো মৌলিক পুনর্লিখনের সম্ভাবনায় উত্তীর্ণ হত না।

 ত্রিশের দশক থেকে আরো ত্রিশ বছর তাঁর কোনো বই ছাপা হয়নি। কিন্তু পীড়ন ও চরম অনিশ্চয়তার সেই দশকেও বাখতিন ছিলেন সবচেয়ে বেশি সৃষ্টিশীল এবং মননের দিক দিয়ে সদাজাগ্রত। সে-সময় তিনি শিক্ষাবিষয়ক উপন্যাস সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন; উপন্যাসের ইতিহাস সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গ্রন্থাকৃতি সম্পন্ন নিবন্ধ লেখেন এবং রাবেলে বিষয়ে অভিসন্দর্ভ ডক্টরেট ডিগ্রির জন্যে প্রস্তুত করেন। এও আসলে জীবনের অন্তর্বৃত দ্বিবাচনিকতার বৌদ্ধিক অভিব্যক্তি। কুস্তানাই শহরে অবশ্য এই দশকের পুরো সময়টা বাখতিনকে কাটাতে হয়নি। নির্বাসনের পালা শেষ হওয়ার পরে মোর্ডোভিয়ার সারান্‌স্ক শহরে শিক্ষকপ্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে তিনি চাকরি

৭৫