পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চার

প্রতীচ্যের বিশ্লেষণ-নিপুণ বাঘা-বাঘা পণ্ডিতেরা খুব সুবিধাজনক ভাবে যে-কথাটা এড়িয়ে গিয়ে মার্ক্সবাদী ভাবনাপ্রস্থানকে নস্যাৎ করেন, তা হলো এই মৌল মার্ক্সীয় প্রস্তাবনা—‘মার্ক্সবাদ কোনো আপ্তবাক্য নয়, তা আসলে কার্যক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক।’ জীবন তো তত্ত্বের মাপে তৈরি হয় না, তত্ত্বই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে গড়ে ওঠে এবং প্রয়োজনের তাগিদে ক্রমাগত বদলে যায়। অতএব বাখতিন যদি মার্ক্সীয় প্রেক্ষণ স্বীকার করে নিয়ে তাঁর সন্দর্ভে মার্ক্সবাদী চেতনার সুরে-লয়ে বাঁধা পরিসরকে বারবার পুনরাবিষ্কার, পরিশীলিত ও সমৃদ্ধতর করেন—তাহলে, বুঝতে হবে, এই তাঁর ভাবনাপ্রস্থানের অন্যতম ধ্রুবক। তিনি যে বহুমাত্রিক চিন্তাবীজকে ক্রমশ অনেকার্থ-দ্যোতনায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তার সূচনাবিন্দু এবং মৌল সঞ্চালক হলো এই চেতনা। সোভিয়েত চিন্তাবিদ অধ্যাপক ই. বালের এই প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন: ‘Undoubtedly, in his creativity, each scientist, writer, artist or composer has to answer the questions posed by life, yet how and when he answers them is determined by his talent and his ability to comprehend the present sooner and better than the others and to foresee the future.’ (১৯৮৪: ৫৬)। এই সূত্র অনুযায়ী, বাখতিন জীবনের দ্বারা উত্থাপিত প্রশ্নমালার মীমাংসাপ্রয়াস অক্ষুণ্ণ রেখেছেন বলেই পর্ব থেকে পর্বান্তরে তাঁর প্রতিভা ও ক্ষমতা ধরা পড়েছে। সাম্প্রতিক কাল ও পরিসরের বহুবিধ বিচ্ছুরণকে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক মার্ক্সবাদীর তুলনায় তিনি বেশি সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন। ভাববিশ্বের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের প্রতি যে-ইশারা তিনি করে গেছেন—আজ বিশ্বব্যাপ্ত বাখতিন-চর্চার মধ্যে তার অসামান্য গুরুত্ব প্রমাণিত হচ্ছে। মার্ক্সীয় চেতনার সৃজনশীল পুনর্বিন্যাস করতে পেরেছিলেন বলেই কোনো অশ্মীভূত আপ্তবাক্যের কবলে তাঁর সন্দর্ভ পড়েনি; প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তিনি নিতে পেরেছেন উজ্জ্বল পথপ্রদর্শকের ভূমিকা। এই চেতনার উত্তরাধিকারকে তিনি ছেদহীন, উচ্চাবচতাহীন যান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় গ্রহণ করেননি। দ্বিবাচনিকতার শর্ত অনুযায়ী চিন্তার রৈখিকতা ভেঙে দিয়েছেন এবং ভেঙে দিয়ে, ‘সাংস্কৃতিক বিকাশের জটিল, পরস্পরবিরোধী ও দ্বান্দ্বিক’ (তদেব: ৬৬) চরিত্রকে প্রকাশ করেছেন। আর, এভাবে প্রমাণ করেছেন, মার্ক্সবাদীরা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ায় যে ‘invariably deal with a progressive form of continuity only’ (তদেব: ৭৭) এর কথা বলেন—ধারাবাহিকতার সেই প্রগতিশীল চরিত্র বাখতিন তাঁর সংবেদনশীল কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। নিজের ইতিহাস নিজেই নির্মাণ করার যে মহাসূত্র এঙ্গেলস্ দিয়েছেন (দ্রষ্টব্য:—Selected Correspondence: 395), বাখতিনের জীবন ও মননের দ্বিবাচনিকতা তার চমৎকার দৃষ্টান্ত।

 বিশের দশকের শেষে বাখতিন টলস্টয় সম্পর্কে দুটি ছোট্ট নিবন্ধ লেখেন, যাতে মার্ক্সীয় ঘরানার ছাপ খুব স্পষ্ট। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে তাঁর দার্শনিক বিবর্তনে এই পর্যায়টি নেহাত আকস্মিক ও পারম্পর্যহীন অর্থাৎ বাখতিনীয় ভাববিশ্ব গড়ে উঠেছে এমন কিছু উপাদানের সমন্বয়ে যা জরুরি নয় তত এবং যা সুবিধাবাদের পোষক। একথা ভাবার মানে যে বাখতিনের বৌদ্ধিক সততাকে খারিজ করে দেওয়া, তা না লিখলেও চলে। প্রচলিত ও বাঁধা-ধরা পথে চলেননি বলে ধ্রুপদী মার্ক্সবাদীরা তাঁর উপর

৭৮