পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ক্ষুব্ধ, বিরক্ত ও সন্দিহান—আবার সম্ভাব্য মার্ক্সীয় অনুষঙ্গের জন্যে প্রতীচ্যের ধুরন্ধর পণ্ডিতেরা প্রাণপণে সেই ‘স্পর্শদোষ’ কাটানোর চেষ্টায় ব্রতী। সত্যকে যিনি দ্বিবাচনিক বলে জেনেছেন, সময়ের বিচিত্র কৌতুকে তাঁর মননবিশ্বকে দুটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান থেকে একবাচনিক বলে প্রমাণ করার জন্যে কী উদগ্র ব্যাকুলতা! সমস্ত বিশ্লেষণ যে মূলত ভাবাদর্শ ভিত্তিক, এতে তার প্রমাণ পাচ্ছি। বাখতিনের উদার মানবতন্ত্রী উচ্চারণের সঙ্গে মার্ক্সবাদের বিরোধ কল্পনা করে যাঁরা সন্তুষ্ট কিংবা বিক্ষুব্ধ—তাদের উভয়ের ক্ষেত্রেই অপরতার উপলব্ধি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। অন্ধের হাতি দেখার পুরোনো রূপকটি হয়তো মনে পড়বে কারো কিংবা উপনিষদের ধরনে বলতে ইচ্ছে করবে—‘অবিজ্ঞাতং বিজানতাম্, বিজ্ঞাতম্ অবিজানতাম্’। মার্ক্সীয় অনুষঙ্গের মধ্যে যাঁরা অতিসরলীকরণ, বিকৃতায়ন বা একবাচনিকতার লক্ষণ খুঁজে পান—তাঁদের পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তের আড়ালে চলে গেছে বাখতিনের জীবনব্যাপী মননের নির্যাস। অস্তিত্ব যাঁর কাছে অংশীদার হওয়ার নিরন্তর প্রক্রিয়া এবং তাৎপর্য যাঁর কাছে সামাজিক ভাবে নির্ধারিত অনেকার্থদ্যোতনার গ্রন্থনা—তাঁকে ইতিহাসের পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার প্রয়াস আসলে প্রতিভাবাদর্শের অভিব্যক্তি। বিপ্লবোত্তর বাস্তবকে যাঁরা কৃষ্ণবিবর বলে প্রমাণ করতে মরিয়া, তাঁরা একদিকে বলেন, সমকালীন রুশ সমাজেও প্রধান উচ্চারণ মার্ক্সীয় চেতনা নয়, আবার অন্যদিকে তাদের অক্লান্ত পুনরাবৃত্তি হলো, মার্ক্সবাদ বৌদ্ধিক বর্গের ওপর আরোপিত হয়েছিল ‘as the deadening intellectual orthodoxy!’ (ডেণ্টিথ: ১৯৯৫: ১১)।

 তার মানে, মার্ক্সীয় চেতনা কোনো উত্তরণমনস্ক বিশ্বাসের আয়ুধ—প্রতীচ্যের বিশেষজ্ঞরা কিছুতেই তা মানতে রাজি নন। তাঁদের অবস্থানের পক্ষে মানানসই রাজনীতির প্রয়োজনে এঁরা যেমন সত্যকে উৎপাদন করে থাকেন এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে নিজস্ব বর্গের তাগিদ অনুযায়ী সাজিয়ে নেন তেমনি বাখতিনকেও তাঁরা নিজেদের ছাঁচে গড়ে নিতে চেয়েছেন। তাঁরা এও বলতে চেয়েছেন যে বাখতিনের ওপর মার্ক্সবাদের প্রভাব ততটা ছিল না যতটা ছিল সমসাময়িক টালমাটাল সমাজের অভিঘাত। একক বাচনকে তিনি যে চিরকাল সামূহিক বাচনের অন্তর্বয়ন হিসেবে জেনেছেন, তার পেছনে এঁরা কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঞ্জীবনী উত্তাপ খুঁজে পাননি। বরং বিমূর্তায়িত সামাজিক আলোড়নের ঘাত-প্রতিঘাতে তাঁর ‘overwhelming sense of the transfigurative power of collective life’ (তদেব: ১৪) উদ্ভূত হওয়ার কথাই বলেছেন। সূর্য উঠলেও যারা সেই সত্য অস্বীকার করে ‘কে বা আঁখি মেলে রে’ জাতীয় অবস্থান নেয়—এখানে যেন তেমনি জ্বলন্ত বাস্তবকে ইচ্ছা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পরিচিত প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। যার অস্তিত্ব সইতে পারি না, তাকে প্রাণপণে অস্বীকার করে মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা মেটাই: এখানে সেই অভ্যস্ত পুরোনো রীতির প্রতিফলন দেখছি। সেসময়কার দার্শনিক প্রবণতা অনুযায়ী নব্যকাণ্টীয় চিন্তাধারা বাখতিনকেও আকৃষ্ট করেছিল যদিও বিশুদ্ধ জ্ঞানতাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা তাঁর ছিল না। চেতনাকে বহিরঙ্গ জগতের নিছক প্রতিফলন বলে ব্যাখ্যা তিনি করেননি কারণ মন তাঁর কাছে এমন কোনো সাদা পাতা নয় যাতে জগতের সানুপুঙ্খ অভিজ্ঞতা মুদ্রিত হবে। নিজের বাইরে বড়োসড়ো যে-জগৎটি রয়েছে, তার স্বরূপ উপলব্ধি ও ব্যাখ্যার জন্যে চেতনা নিজস্ব স্বতন্ত্র প্রকরণ তৈরি করে নেয়। বিশেষত

৭৯