পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শব্দটি, যাবতীয় যথাপ্রাপ্তকে বিনির্মাণ করার মতো বিস্ফোরক এর মধ্যে মজুত রয়েছে। কেন্দ্রীয় কুশীলবের কথায় ও কাজে বহির্বৃত অপর পরিসরের নিরন্তর অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ব্যক্ত হয়েছে। নিছক উন্মাদের পাঠক্রম রচনা যে করেনি হারবার্ট, তা লেখকের এই ইঙ্গিতপূর্ণ উপস্থাপনায় স্পষ্ট: ‘এল. টি. টি. ই-র লাইভ হিউম্যান বম্‌ব ধানুর সঙ্গে তুলনীয় হারবার্ট ছিল একটি ডেড্ হিউম্যান বম্‌ব। …গত দুই দশক ধরে এই বিস্ফোরক সমাহার তোষকের মধ্যে শীতঘুম ঘুমোচ্ছিল যা চুল্লির উত্তাপে জেগে ওঠে। …হারবার্টের রক্তহীন মৃতদেহ দাহ করার সময় জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল তা অবধারিত ভাবে এই ইঙ্গিতই দিয়ে চলে যে কখন, কোথায়, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।’ (পৃ. ৫৭)।

 এই বিন্দুতে এসে মনে হয়, কার্নিভাল কেবল সাহিত্যিক কৃৎকৌশল নয়; কার্নিভালের ধারণায় রয়েছে মুক্ত পরিসর, রয়েছে তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক অন্তঃস্বর। সর্বত্র-ব্যাপ্ত আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধা জানাতে গিয়ে ঐ মুক্ত পরিসরের সম্ভাবনাকেই কাজে লাগাতে হয়। পাঠকৃতির নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে, রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিকতার নানা আয়োজন। সেখানে হস্তক্ষেপ করতে হলে মনে রাখতে হয় যে পাঠকৃতিও যুদ্ধক্ষেত্র; লেখা ও পড়া—দু’টি ক্রিয়াই মূলত যুদ্ধ। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সমস্ত তাৎপর্য অর্জনীয় বলেই লেখার কার্নিভালীকরণ যা ঘটিয়ে দেয়, তা যুগপৎ নান্দনিক ও রাজনৈতিক উন্মোচন। নবারুণ হারবার্ট-এ কার্নিভালের নাগরিক প্রয়োগ সম্পন্ন করেছেন। সাম্প্রতিক তাত্ত্বিকেরা আধুনিকোত্তর কার্নিভাল, প্যারডি, শ্লেষ ও হাসি সম্পর্কে যে-সব আলোচনা করেছেন, সেই নিরিখে বলা যায়, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পুরোপুরি নতুন স্তর আবিষ্কার করতে পারি তাতে। একটু আগেই লক্ষ করলাম যে কার্নিভালের ধারণা শুধুমাত্র মধ্যযুগীয় অনুষঙ্গে সীমাবদ্ধ থাকে না; আধুনিক এবং আধুনিকোত্তর কালপর্বেও সাংস্কৃতিক ইতিহাস পাঠের অভিনব পদ্ধতিকে ব্যবহার করা সম্ভব। তাই বাখতিনের আদি প্রেরণা থেকে সময় ও পরিসরের বিচারে বহু দূরবর্তী বয়ানেও কার্নিভালীকরণের ভাববীজ ব্যবহার করা যাচ্ছে। এপ্রসঙ্গে চার্লস জেঙ্কস-এর একটি মন্তব্য উল্লেখ করতে পারি: ‘The Carnivalesque in postmodern literature is the crossing of boundaries, the breakdown of all categories of class, sex and genre that occurs in any carnival worthy of the name’ (১৯৯১: ১৭)।

 বিভিন্ন বর্গায়তনের মধ্যবর্তী সীমান্ত যখন মুছে যায়, প্রান্তিকায়িত স্তরের উপেক্ষিত উপাদান শ্লেষ ও পরিহাসের অন্তর্ভেদী শক্তি নিয়ে অবতল থেকে ঊর্ধ্বায়িত হয়ে ওঠে। আধুনিকোত্তর সাহিত্য যেহেতু যুগপৎ উপস্থাপিত বক্তব্যকে সমর্থন দেয় ও প্রশ্নে বিদ্ধ করে—আপাতদৃষ্টিতে কার্নিভালের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রবণতার সঙ্গে কূটাভাসের সম্পর্ক তৈরি হয়। কেউ কেউ এমনও ভাবতে পারেন যে কার্নিভালের প্রধান উপজীব্য হাসি তাতে গোপন বিষণ্ণতার চোরাবালিতে হারিয়ে যায়। বাখতিনের মৌল অভিপ্রায় থেকে বিচ্যুত হলে বিদ্রূপগর্ভ বা পরিহাসপ্রবণ বিপ্রতীপায়ন কীভাবে কার্নিভাল বলে বিবেচিত হতে পারে? আসলে খুব সতর্কভাবে বিষয়টির মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন। সরকারি কর্তৃত্ব ও প্রতিষ্ঠিত বিধি-বিন্যাস যে জীবনে মননে নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপ আরোপ করে—তাকে প্রত্যাহ্বান জানাতে প্রান্তিক অবতল থেকে উঠে আসে কার্নিভালের প্রতিস্রোত। অতি-উদ্ভাসন

৯০