পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সর্বজনীন বলে উপস্থাপিত করে তারা। তবু উদ্ভাসনের আতিশয্য সত্ত্বেও মিথ্যার এই প্রগল্‌ভতাকে ধরিয়ে দিতে পারে কার্নিভাল। কেননা ঐতিহ্যের চিরায়তনে লোকসমাজের শিকড় অত্যন্ত দৃঢ়, সাময়িক আঁধি সত্ত্বেও সেখানে ব্যাপক বিচ্ছেদের কোনো অবকাশ নেই। বাখতিন যাকে ‘collective ancestral body of all the people’ (১৯৮৪: ১৯) বলেছেন, ব্যতিরেকী দৃষ্টিভঙ্গির উৎস সেখানেই। ষোল শতকে রচিত রাবেলের উপন্যাসে তিনি যে জনপ্রিয় উৎসব-মুখরতার ওপর সর্বাত্মক নির্ভরতা লক্ষ করেছেন, তাতে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে অর্জিত সামূহিক বয়ানের পরম্পরার প্রতি মান্যতা ফুটে উঠেছে। গোষ্ঠীগত ধারাবাহিকতার বোধ ছাড়া এই মান্যতা সম্ভব নয়। কার্নিভালমূলক চিত্রকল্প ও চিহ্নায়কের বিপুল ভাণ্ডার থেকে রাবেলে ঋণ গ্রহণ করেছেন এবং মধ্যযুগের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির রুদ্ধতার বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহার করেছেন। জনপ্রিয় আনন্দ ও ইতিবাচকতার প্রেরণা হিসেবে বাখতিন শারীরিক অনুষঙ্গের বস্তুতান্ত্রিক স্বভাবের বিশেষ গুরুত্ব লক্ষ করেছেন। বিমূর্তায়নের প্রতি উচ্চসংস্কৃতির যে ঝোঁক রয়েছে, এর কারণ একে মনস্তাত্ত্বিক প্রেরণায় অভিজাত বলে ধরে নেওয়া হয়। কৃত্রিম নির্মিতির প্রতি একরৈখিক আনুগত্য থাকায় অকৃত্রিম স্বতঃস্ফূর্ত শারীরিক অভিব্যক্তির বস্তুতন্ত্রকে উচ্চসংস্কৃতি চিরকালই তাচ্ছিল্য দেখিয়েছে এবং অবদমিত করেছে। রাবেলে মূলত এই অবদমনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিকল্প নন্দন ও বিকল্প প্রতিবেদনের প্রস্তাবনা করেছিলেন। বাখতিন তাঁর বইতে নিঃসন্দেহে এমন-এক নন্দনের কথা জানিয়েছেন যা ‘celebrates the anarchic, body-based grotesque elements of popular culture, and seeks to mobilize them against the humanless seriousness of official culture.’ (ডেন্‌টিথ: প্রাগুক্ত: ৬৬)।

 জনপ্রিয় সংস্কৃতির মধ্যে ইন্দ্রিয়ঘন দৈহিকতা ও উদ্ভট উপাদানের প্রতি যে আকর্ষণ দেখা যায়, তাতে নৈরাজ্যের বৈশিষ্ট্য থাকলেও সরকারি মনোভঙ্গি প্রত্যাখ্যানের তাগিদই আসল। প্রতিবাদী নন্দন গড়ে ওঠে এই প্রবণতা থেকেই। উদ্ভট বা আতিশয্য লোকবৃত্তে নিহিত অসঙ্গতির প্রমাণ নয়, এদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারি বয়ানের বিরুদ্ধে হাসিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে গণমন। ‘Grotesque realism’ নামক বিশেষ পারিভাষিক শব্দবন্ধ দিয়ে রাবেলের রচনাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বস্তুতন্ত্র ও শারীরিক অনুষঙ্গের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে দেখানো হয়েছে কীভাবে এরই প্রভাবে লিখনশৈলী কার্নিভালীকৃত হয়ে যায়। ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর করার মধ্য দিয়ে যে ধরনের জৈবিক বৃত্তি ব্যক্ত হয়, তাকে আড়াল করার পরিবর্তে কার্নিভাল-অনুপ্রাণিত লেখক শারীরিক উপস্থিতিকে যেন উৎসবে রূপান্তরিত করেন। এইজন্যে লেখককে সতর্ক মাপজোখ ও পরিশীলনের পথ ছেড়ে দিয়ে আদিমতা, আতিশয্য ও উদ্ভটের পথ গ্রহণ করতে হয়।

 তাই বাখতিনকে লিখতে হয়েছে: ‘The essential principle of grotesque realism is degradation.’ (তদেব: ১৯)। তবে এই আপাতস্থূলতা বা অবনমন নিছক নেতিবাচক প্রক্রিয়ামাত্র নয়। খনি থেকে তুলে-আনা আকাটা হিরের মতো লোকায়ত জীবনে উদ্ভট ও অসঙ্গত বলে প্রতীয়মান বস্তু আসলে মূল্যবান চিহ্নায়ক। এই বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় যে প্রসাধন ও পরিচ্ছদের আড়ম্বর আমাদের বিভ্রান্ত করে। মানুষ মূলত বিমূর্ত ও বায়বীয় নয়; রক্ত-মাংস-হাড়-মজ্জার বাস্তবতাকে অস্বীকার

৯৩