পাতা:বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী.djvu/১০

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৪
বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী

প্রথায় কেন? মনের ফুল বনের ফুলের সাথী হয়ে ফুটলো,—এর বেশিও তো শিল্পীর দিক থেকে চাওয়ার প্রয়োজন নেই; তবে কেন অধম শিল্পী হলেও আমি ছুটে মরবো যথা-তথা হ্যাণ্ডবিল বিলিয়ে? এ আশঙ্কার কারণ তো আমি বুঝিনে। মধুকর মধু নিয়ে তৃপ্ত হন; এতে ফুলের যতটুকু আনন্দ, তার চেয়ে শিল্পীর সজীব আত্মা সমজদার পেলে আর একটুখানি আনন্দ বেশি পায় সত্য, কিন্তু সেটা তার উপরি-পাওনা— হলেও হয়, না হলেও চলে। শিল্পীর যথার্থ আনন্দ হচ্ছে ফোটার গৌরবে। গোলাপ সৌরভ ছড়িয়ে রাঙা হয়ে ফুটলো, শিমুলও ফুটলো রাঙা হয়ে—খালি তুলোর বীজ ছড়াতে, কিন্তু রসিক যে, সে তো সেই দুই ফুলেরই ফোটার গৌরব দেখে খুসি হয়। এই ফোটার গৌরব দিয়ে ওস্তাদ যাঁরা, তাঁরা শিল্পীর কাজের তুলনা করে থাকেন—“দিবস চারকে সুরংগ ফুল, ওহি লখ মনমে লাগল্ শূল!”—দু দণ্ডের জীবন ফুটলো, রসিকের এই দেখেই মন বলে—মরি মরি! এইখানেই শিল্পীতে আর কারিগরে তফাৎ; শিল্পের মধ্যে শিল্পীর মন ফুটন্ত হয়ে দেখা দিলে, আর কারিগরের গড়া অতি আশ্চর্য্য কাগজের ফুল ফুটন্ত ফুলকেও হার মানালে, কিন্তু মনের রস সেটাকে সজীব করে দিলে না। জগতে কারিগরেরই বাহবা বেশি শিল্পীর চেয়ে, কেন না কারিগর বাহবা পেতেই গড়ে, শিল্পী গড়ে চলে নিজের কাজের সঙ্গে নিজকে ফুটতে বোধ করতে-করতে। এই কারণেই শিল্পচর্চ্চার গোড়ার পাঠ হচ্ছে শিল্পবোধ, যেমন শিশুশিক্ষার গোড়াতে হচ্ছে শিশুবোধ।

 রসবোধই নেই রস-শাস্ত্র পড়তে চলায় যে ফল, শিল্পবোধ না নিয়ে শিল্পচর্চ্চায় প্রায় ততটা ফলই পাওয়া যায়। এর উল্টোটা যদি হতো, তবে সব কটা অলঙ্কার-শাস্ত্রের পায়েস প্রস্তুত করে পান করলেই ল্যাটা চুকে যেত। মৌচাকের গোপনতার মধ্যে কি উপায়ে ফুলের পরিমল গিয়ে পৌঁছচ্ছে তা দেখতে পাওয়া যায়; কিন্তু মধুর সৃষ্টি হচ্ছে একটা প্রকাণ্ড রহস্যের আড়ালে। তেমনি মানুষের রসবোধ কি উপায়ে হয়, কেমন করে, অলঙ্কার-শাস্ত্রে রস-শাস্ত্রে তারি জল্পনা যেমন দেখি, তেমনি এও তো দেখি যে রস-শাস্ত্র নিংড়ে পান করেও কমই রসিক দেখা দিচ্ছে। এই যে আলো-মাখা রামধনুকের রঙে বিচিত্র বিশ্বচরাচরের অফুরন্ত রস, এ তো মাটি থেকে প্রস্তুত রঙের বাক্সয় ধরা পড়ে না,