পাতা:বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী.djvu/৭২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৬৬
বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী

নিরূপিত নির্বাচিত করে’ চলেছে মানুষ—এই হ’ল গোড়ার কথা। যারা জীবন্ত কিম্বা যারা গতিশীল কেবল তাদেরই আদি যুগের মানুষেরা চিত্রের ভাষায় ধরতে চেয়েছে গাছ, পাথর, আকাশ যারা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, শব্দ করে না, চলে না, বলেও না, আলোতে অরণ্যানীর মতো হঠাৎ দেখা দেয় আবার অন্ধকারে হঠাৎ মিলিয়ে যায়, ছবির ভাষায় তাদের ধরা তখন সম্ভব বোধ করেনি মানুষ, হয়তো বা কথিত ভাষাতেও এ সব বর্ণন করে নি তখনকার মানুষ, কেন যে তা এক প্রকাণ্ড রহস্য! ধরতে গেলে, বিদ্যুৎগতিতে দৌড়েছে যে হরিণ কি মাছ তাদের ছবিতে ধরার চেয়ে, পাথর গাছ কি ফুল যারা স্থির রয়েছে চিরকাল ধরে’, আঁকা দিয়ে তাদেরই ধরা সহজ ছিল, কিন্তু তা হয়নি। গাছ, পালা, পাহাড়, পর্বত, এরা বাদ পড়ে গেল, আর যাদের শব্দ অঙ্গভঙ্গি এই সব আছে—এক কথায় যাদের ভাষা আছে—পুরাতন মানুষের ছবির ভাষা আগে গিয়ে মিল্লো তাদেরই সঙ্গে! এ যেন মানুষের সঙ্গে চারিদিকের যারা এসে কথা কইল তাদেরই পরিচয় আগে লিখ্‌তে বস্‌লো মানুষ; জলকে মানুষ জিজ্ঞাসা কর্‌লে—জল, তুমি কেমন করে চল? জল স্রোতের রেখা ও গতি-ভঙ্গি দিয়ে এঁকে ইঙ্গিত করে’ শব্দ করে’ যেন জানিয়ে দিলে—এমনি করে ঢেউ খেলিয়ে এঁকে বেঁকে চলি। হরিণ, তুমি কেমন করে দৌড়ে যাও?—হরিণ সেটা স্পষ্ট দেখিয়ে গেল। কিন্তু গাছকে পাথরকে শুধিয়ে মানুষ পরিষ্কার সাড়া পেলে না। গাছ, তুমি নড় কেন? এর উত্তর গাছ মর্মর ধ্বনি করে’ দিলে—এই এমনিই নড়ি থেকে থেকে, জানিনে কেন! গাছের কথাই বোঝা গেল না, ছবিতেও তার রূপ ধরলে না মানুষ। পাহাড়, দাঁড়িয়ে কেন? আকাশ দিয়ে মানুষের জিজ্ঞাসার প্রতিধ্বনি ফিরে এল, কেন! ছবির ভাষায় এদের কথা লেখা হলই না, শুধু এদের বোঝাতে মানুষ গাছ বল্‌তে গোটাকতক দাঁড়ি কসি, পাহাড় বল্‌তে একটা ত্রিকোণ-চিহ্ণ দিয়ে গেল কখন কখন কতকটা চীনে অক্ষরের মতো,—রূপাভাষ, কিন্তু পুরো রূপচিত্র নয়। ব্রতধারী মানুষ কামনা ব্যক্ত করবার সময় পুরাকাল থেকে আজ পর্যন্ত যে কথা, ছবি, সুর, নাট্য ইত্যাদি মিশ্রিত ভাষা প্রয়োগ করে চলেছে তার রীতি আমাদের এখনো ধরে থাক্‌তে হয়েছে,—শুধু এক কালের অস্ফুট শিশুভাষ স্ফুটতর হয়ে উঠেছে, পুরাকালের ব্রতধারীর ভাষার সঙ্গে এখনকার ভাষার।