পাতা:বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী.djvu/৭৪

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৬৮
বাগেশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী

করে…।” বিশ্বরাজ্যের প্রকট রূপ রস শব্দ গন্ধ স্পর্শ সমস্তই পাচ্ছিল মানুষ ভাষাকে পাবার আগে থেকে, কিন্তু মনের মধ্যে তবুও মানুষের একটা বেদনা জাগছিল—মনের কথাকে খুলে বলবার বেদনা, মানসকে সুন্দররূপে প্রকট করার বাসনা, সুপরিষ্কৃত ভাষাকে পাবার জন্যে বেদনা মনে জাগছিল। মানুষের সব চেয়ে যে প্রাচীন ভাষা তাই দিয়ে রচা বেদ এই বেদনের সুরে ছত্রে ছত্রে পদে পদে ভরা দেখি; “আমার কর্ণ, আমার হৃদয় আমার চক্ষুর্নিহিত জ্যোতি সমস্তই তোমাকে নিরূপণ করিতে অবগত হইতে ধাবিত হইতেছে…দূরস্থবিষয়ক চিন্তাব্যাপৃত আমার হৃদয় ধাবিত হইতেছে…আমি এই বৈশ্বানর স্বরূপকে কিরূপে বর্ণন করি কিরূপই বা হৃদয়ে ধারণ করি!” কিম্বা যেমন—“কিরূপ সুন্দর স্তুতি ইন্দ্রকে আমাদের অভিমুখে আনয়ন করিবে।” হৃদয়ের বেদনার অন্ত নেই, দেখতে চেয়ে শুন্‌তে চেয়ে প্রাণ ব্যথিত হচ্ছে, ধাবিত হচ্ছে। অতি মহৎ জিজ্ঞাসার উত্তর পাচ্ছে মানুষ অতি বৃহৎ পরম সুন্দর, কিন্তু তার প্রত্যুত্তরের মতো মহাসুন্দর ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না!—“যজ্ঞের সময় দেবতারা আমাদিগের স্তব শুনিয়া থাকেন, সেই বিশ্বদেবতাসকলের মধ্যে কাহার স্তব কি উপায়ে উত্তমরূপে রচনা করি!” মনের নিবেদন সুন্দর করে উত্তম করে জানাবার জন্য বেদনা আর প্রার্থনা। কোন রকমে খবরটা বাৎলে দিয়ে খুসি হচ্ছে না মানুষের মন, সুন্দর উপায় সকল উত্তম উত্তম সুর সার কথা গাথা ইঙ্গিতাদি খুঁজছে মানুষ এবং তারি জন্যে সাধ্য সাধনা চলেছে—“হে বৃহস্পতি! আমাদিগের মুখে এমন একটি উজ্জ্বল স্তব তুলিয়া দাও, যাহা অস্পষ্টতাদোষে দূষিত না হয় এবং উত্তমরূপে স্ফূরিত হয়।” ছবি দিয়ে যে কিছু রচনা করতে চায় সেও এই প্রার্থনাই করে—রং রেখা ভাব লাবণ্য অভিপ্রায় সমস্তই যেন উজ্জ্বল এবং সুন্দর হয়ে ফোটে। ধরিত্রীকে বর্ণন করতে ঋষি গতিশীল স্তোত্র আর ভাষা চাইলেন। ভাষার পথে গতি পৌঁছয় কোথা থেকে? মানুষের মনের গতির সঙ্গে ভাষাও বদলে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি—বাঙ্গলার পক্ষে সংস্কৃতমূলক সাধুভাষা হল অচল ভাষা, কেননা সে শব্দকোষ ব্যাকরণ ইত্যাদির মধ্যে একেবারে বাঁধা, মনের চেয়ে পুঁথির সঙ্গে তার যোগ বেশি! বাঙ্গালীর মন বাঙ্গলায় জুড়ে আছে, সুতরাং চলতি বাঙ্গলা চলেছে ও চলবে চিরকাল বাঙ্গালীর মনের