পাতা:বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রথম ভাগ.djvu/৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করার সময় সমস্যা ছিল।
ভূমিকা

জাতি বাঙ্গালীর সাগর-বিশাল মাতৃভাষার অভিধানের স্থান ও মর্য্যাদার প্রতি অবহিত থাকিয়া ইহার দ্বিতীয় সংস্করণ সম্পাদন করিতে শ্রদ্ধাপূর্ণ হৃদয়ে যত্নের ত্রুটি করি নাই।

 বিভক্তি-বিহীন সংস্কৃত-শব্দ-বাহুল্যে কালক্রমে বাঙ্গালা লেখ্য-ভাষা দুষ্পাঠ্য বাঙ্গালা অভিধানগুলি প্রকৃতিতে যে সংস্কৃতের ছাঁচে ঢালা এবং কলেবরে অসঙ্গত ও অসংযত দুষ্পাঠ্য হইয়া উঠিতেছিল, পণ্ডিতী সাধু আখ্যাপ্রাপ্ত বাঙ্গালাভাষায় তাহার পরিচয়ের অভাব নাই। “কোকিল কলালাপবাচাল যে মলয়াচলানিল, সে উচ্ছ্বলচ্ছীকরাত্যচ্ছ নিঝরাম্ভকনাচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে” তাহারই একটি নমুনা। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় কর্ত্তৃক সংগৃহীত “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালাভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা” গ্রন্থে বৌদ্ধ-বাঙ্গালার সংস্কৃত টীকা ও ব্যাখ্যা দেখিলে বুঝা যায়, সংস্কৃত পণ্ডিতগণ কর্ত্তৃক ইতর-ভাষা বলিয়া অবজ্ঞাত বাঙ্গালার উপর সংস্কৃতের প্রভাব কতদূর বিস্তারলাভ করিয়াছিল; এবং তাহার মর্য্যাদাবর্দ্ধন বা শিক্ষিত সমাজে সুবোধ্য ও আদরনীয় করিবার জন্য সংস্কৃতের প্রয়োজন কত অধিক বোধ হইত। তখন খাঁটি বাঙ্গালাভাষার নাম ছিল সংস্কৃত হইতে ভ্ৰষ্ট—“অপভাষা” “অপভ্রষ্টভাষা” বা “ইতরভাষা”। কিন্তু তখনকার পণ্ডিতসমাজ-নিন্দিত অবজ্ঞাত এই অপভাষাই ছিল আমাদের প্রাণসঞ্চারিণী বাঙ্গালা ভাষা। অপভাষায় তখন গ্রন্থ লিখিবার দুঃসাহস যাঁহারা রাখিতেন, তাঁহারা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতমণ্ডলীর দিকে চাহিয়া যেন কোন অজ্ঞাত অপরাধের জন্য মার্জ্জনা ভিক্ষা করিয়া অতীব সঙ্কোচে, অতি ভয়ে ভয়ে কলম ধরিতেন। তখন Phonetic spelling অর্থাৎ উচ্চারণগত বানানই এখনকার অপেক্ষা অধিক প্রশস্ত ছিল এবং তাহা প্রাদেশিক বৈভিন্ন-প্রভাবে নানা রূপান্তর গ্রহণ করিয়ছিল। কিন্তু এই বৈচিত্রময় ভাষাই ছিল প্রাচীন বাঙ্গালীর প্রধানতঃ কথ্য এবং অংশতঃ সংস্কৃতানভিজ্ঞদের লেখ্য-ভাষা। এই ভাষায় যাঁহারা প্রথম প্রথম বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও অভিধান প্রণয়নের প্রয়োজন বোধ করিয়াছিলেন তাঁহাদের পূর্ব্বতম পথ-প্রদর্শক ছিলেন জনৈক পর্ত্তুগীজ পাদরী মানুএল-দা-আস্‌সুম্প্‌সাঁউ। তাঁহার বাঙ্গালা ব্যাকরণ এবং বাঙ্গালা পর্ত্তুগীজ ও পর্ত্তুগীজ বাঙ্গালা শব্দকোষ রোমান অক্ষরে মুদ্রিত হইয়াছিল। পরে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সিভিল (অসামরিক) কর্ম্মচারী নাদেনিএল ব্রাসী হলহেড্ সাহেব ১৭৭৮ খ্ৰীষ্টাব্দে বঙ্গাক্ষরে একখানি বাঙ্গালা ব্যাকরণ লেখেন এবং তাঁহারই সমসাময়িক যুগপ্রবর্ত্তক মহাত্মা রাজা রামমোহন রায় তাঁহার “গৌড়ীয় ব্যাকরণ” লিখিয়া এই অভাব দূর করিতে মনস্থ করিয়াছিলেন। কিন্তু সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতমণ্ডলীর প্রভাবে এবং তৎকালীন লেখক ও পাঠক সাধারণের উৎসাহ ও সহানুভূতি অভাবে, সংস্কৃত-ব্যাকরণের সূত্রানুশাসনবর্জ্জিত বাঙ্গালা ব্যাকরণগুলি ভাষার ইতিহাসগর্ভে আত্মগোপন করিয়া রহিল এবং সংস্কৃত-ব্যাকরণের বঙ্গানুবাদ ও তাহারই ছাঁচে ঢালা বঙ্গাক্ষরে ও বঙ্গভাষায় লিখিত সংস্কৃত-ব্যাকরণই প্রবল থাকিয়া বাঙ্গালা লেখ্যভাষাকে নিয়ন্ত্রিত করিতে লাগিল। ব্যাকরণের মতই বাঙ্গালা অভিধানগুলি