পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৫

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
বসন্তযাপন
৯১

সার্থকতা, এ কথা আজ আমি কিছুতেই মানিব না। আজ আমাদের সেই যুগান্তরের বড়োদিদি বনলক্ষ্মীর ঘরে ভাইফোঁটার নিমন্ত্রণ। সেখানে আজ তরুলতার সঙ্গে নিতান্ত ঘরের লোকের মতো মিশিতে হইবে। আজ ছায়ায় পড়িয়া সমস্তদিন কাটিবে—মাটিকে আজ দুই হাত ছড়াইয়া আঁকড়াইয়া ধরিতে হইবে—বসন্তের হাওয়া যখন বহিবে, তখন তাহার আনন্দকে যেন আমার বুকের পাঁজরগুলার মধ্য দিয়া অনায়াসে হুহু করিয়া বহিয়া যাইতে দিই—সেখানে সে যেন এমনতরো কোনো ধ্বনি জাগাইয়া তোলে, গাছপালারা যে ভাষা না বোঝে। এমনি করিয়া চৈত্রের শেষ পর্য্যন্ত মাটি, বাতাস ও আকাশের মধ্যে জীবনটাকে কাঁচা করিয়া সবুজ করিয়া ছড়াইয়া দিব—আলোতে-ছায়াতে চুপ করিয়া পড়িয়া থাকিব।

 কিন্তু, হায়, কোনো কাজই বন্ধ হয় নাই—হিসাবের খাতা সমানই খোলা রহিয়াছে। নিয়মের কলের মধ্যে কর্ম্মের যাঁদের মধ্যে পড়িয়া গেছি—এখন বসন্ত আসিলেই কী, আর গেলেই কী।

 মনুষ্যসমাজের কাছে আমার সবিনয় নিবেদন এই যে, এ অবস্থাটা ঠিক নহে। ইহার সংশোধন দরকার। বিশ্বের সহিত স্বতন্ত্র বলিয়াই যে মানুষের গৌরব, তাহা নহে। মানুষের মধ্যে বিশ্বের সকল বৈচিত্র্যই আছে বলিয়া মানুষ বড়। মানুষ জড়ের সহিত জড, তরুলতার সঙ্গে তরুলতা, মৃগপক্ষীর সঙ্গে মৃগপক্ষী। প্রকৃতি-রাজবাড়ীর নানা মহলের নানা দরজাই তাহার কাছে খোলা। কিন্তু খোলা থাকিলে কী হইবে? এক-এক ঋতুতে এক-এক মহল হইতে যখন উৎসবের নিমন্ত্রণ আসে, তখন মানুষ যদি গ্রাহ্য না করিয়া আপন আড়তের গদিতে পড়িয়া থাকে, তবে এমন বৃহৎ অধিকার সে কেন পাইল? পূরা মানুষ হইতে হইলে তাহাকে সবই হইতে হইবে, এ কথা না মনে করিয়া মানুষ মনুষ্যত্বকে বিশ্ববিদ্রোহের একটা সঙ্কীর্ণধ্বজাস্বরূপ খাড়া করিয়া তুলিয়া রাখিয়াছে