পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩২

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১১৮
বিচিত্র প্রবন্ধ

 চর্চ্চা নেই ব’লে জবাব দিলে আমি শুন্‌ব না। মন নেই ব’লেই চর্চ্চা নেই। আকবরের রাজত্ব গেছে এ কথা আমাদের মানতেই হবে। খুব ভালো রাজত্ব কিন্তু কী করা যাবে—সে নেই। অথচ গানেতেই যে সে রাজত্ব বহাল থাক্‌বে এ কথা বলে অন্যায় হবে। আমি বছিনে আকবরের আমলের গান লুপ্ত হয়ে যাবে—কিন্তু এখনকার কালের সঙ্গে যোগ রেখে তাকে টিকতে হবে—সে যে বর্ত্তমান কালের মুখ বন্ধ ক’রে দিয়ে নিজেরই পুনরাবৃত্তিকে অন্তহীন ক’রে তুলবে তা হোতেই পারবে না।

 সাহিত্যের দিক থেকে উদাহরণ দিলে আমার কথাটা স্পষ্ট হবে। আজ পর্য্যন্ত আমাদের সাহিত্যে যদি কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ধর্ম্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, মনসার ভাসানের পুনরাবৃত্তি নিয়ত চল্‌তে থাক্‌ত তাহোলে কী, হোত? পনেরো আনা লোক সাহিত্য পড়া ছেড়েই দিত। বাংলার সকল গল্পই যদি বাসবদত্তা কাদম্বরীর ছাঁচে ঢালা হোত তাহোলে জাতে ঠেলার ভয় দেখিয়ে সে গল্প পড়াতে হোত।

 কবিকঙ্কণ চণ্ডী কাদম্বরীর আমি নিন্দা করছিনে। সাহিত্যের শোভাযাত্রার মধ্যে চিরকালই তাদের একটা স্থান আছে কিন্তু যাত্রাপথের সমস্তটা জুড়ে তারাই যদি আড্ডা ক’রে বসে, তাহোলে সে পথটাই মাটি, আর তাদের আসরে কেবল তাকিয়া পড়ে থাক্‌বে, মানুষ থাক্‌বে না।

 বঙ্কিম আন্‌লেন সাতসমুদ্রপারের রাজপুত্রকে আমাদের সাহিত্য রাজকন্যার পালঙ্কের শিয়রে। তিনি যেমনি ঠেকালেন সোনার কাঠি, অমনি সেই বিজয়-বসন্ত লয়লামজ্‌নুর হাতীর দাঁতে বাঁধানো পালঙ্কের উপর রাজকন্যা ন’ড়ে উঠ্‌লেন। চল্‌তিকালের সঙ্গে তাঁর মালা বদল হয়ে গেল, তার পর থেকে তাঁকে আজ আর ঠেকিয়ে রাখে কে?

 যারা মনুষ্যত্বের চেয়ে কৌলীন্যকে বড়ো ক’রে মানে তারা বল্‌বে ঐ রাজপুত্র টা যে বিদেশী। তারা এখনো বলে, এ সমস্তই ভুয়ো;