পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৬৩

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
চিঠির টুক্‌রি
১৪৯

বাড়িঘর যা-কিছুকে স্পর্শ করছিল তার থেকেই যেন অসীমের সুর বাজিয়ে তুললে। এই হচ্চে চিরপরিপূর্ণতার সুর—আমাদের অহমিকার বেড়াটুকুর মধ্যে যত-কিছু বিঘ্ন বেদনা বিপত্তি—তাকে ডুবিয়ে দিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে এই সুর বয়ে যায়। এর আর ক্ষয় নেই—এই তে বিশ্বকে চিরনবীন ক’রে রেখেছে—যত বড়ো আঘাত যত নিবিড় কালিমাই জগতের গায়ে আঁচড় কাটতে থাকে তার কোনো চিহ্নই থাকে না—পরিপূর্ণের শান্তি সমস্ত ক্ষয়কে অনিষ্টকে নিয়তই পূরণ ক’রে বিরাজ করে। নইলে ভেবে দেখো অতীতের আবর্জ্জনার কী বিষম বোঝা, ব্যক্তিগত মানুষ ও জাতিগত মানুষের কত যুগযুগান্তরের কত বিপুল বেদনা—তার ভার কোথায় গেল! ঐ প্রতিদিন প্রভাতের কাঁচাসোনাকে একটুও ম্লান করতে পারেনি, আর আমার দ্বারের কাছে নীলমণিলতা যে উচ্ছ্বসিত বাণী আকাশে প্রচার করছে আজ পর্য্যন্ত সে একটুও জীর্ণ হোতে জানল না। আমি ঐখান থেকে আমার জীবনের মন্ত্র নিতে চাই, কোনো গুরুভার গুরুবাক্য থেকে নয়—গাছ যেমন ক’রে পাতা মেলে দিয়ে আকাশের আলো থেকে অদৃশ্য অচিহ্নিত পথে ডেকে নেয় আপনার প্রাণ আপনার তেজ। শিশুকালেই এই পরিপূর্ণতার মন্ত্র আমার কানে প্রবেশ করেছে—সেই মন্ত্রই আমাকে নানা দুঃসহ শোক দুঃখ অতৃপ্তি নৈরাশ্যের জটিল কঠিন জাল থেকে মুক্তি দিয়ে এসেছে—পরম দুঃখ বেদনার সময়েই আমি চোখের জলের ভিতর দিয়ে আরো স্পষ্ট ক’রে দেখতে পাই সে দুঃখকে অতিক্রম ক’রে চিরালোকিত চির মুক্তির দিগন্ত রয়েছে। নইলে আমি এতদিন বাঁচতেই পারতুম না, কেননা বেদনাপরতা আমার মধ্যে যত প্রবল এমন অল্পই দেখেছি—বোধ করি সেইজন্যেই সকল বেদনার অতীত যে সত্য তার মধ্যে মুক্তি পাবার জন্যে আমার এমন অনবরত আকাঙ্ক্ষা।