পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
সরােজিনী প্রয়াণ
১৫

 আকাশে তারা উঠিল—দক্ষিণে বাতাস বহিতে লাগিল। খালাসীদের নমাজ পড়া শেষ হইয়া গিয়াছে। একজন ক্ষ্যাপা খালাসী তাহার, তারের যন্ত্র বাজাইয়া, এক মাথা কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুল নাড়াইয়া, পরম উৎসাহে গান গাহিতেছে। ছাতের উপরে বিছানায় যে যেখানে পাইলাম শুইয়া পড়িলাম—মাঝে মাঝে এক-একটি অপরিস্ফুট হাই ও অপরিস্ফুট নাসাধ্বনি শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। বাক্যালাপ বন্ধ। মনে হইল যেন একটা বৃহৎ দুঃস্বপ্ন পক্ষী আমাদের উপরে নিস্তব্ধভাবে চাপিয়া আমাদের কয়জনকে কয়টা ডিমের মতো তা’ দিতেছে। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। আমার মনে হইতে লাগিল ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ।’ যদি এমনই হয়-কোনো সুযোগে যদি একেবারে কুষ্টির শেষ কোঠায় আসিয়া পড়িয়া থাকি, যদি জাহাজ ঠিক বৈতরণীর পর পারের ঘাটে গিয়াই থামে—তবে বাজনা বাজাইয়া দাও—চিত্রগুপ্তের মজলিষে হাঁড়ি মুখ লইয়া যেন বেরসিকের মতো দেখিতে না হই। আর, যদি সে জায়গাটা অন্ধকারই হয় তবে এখান হইতে অন্ধকার সঙ্গে করিয়া রাণীগঞ্জে কয়লা বহিয়া লইয়া যাইবার বিড়ম্বনা কেন? তবে বাজাও! আমার ভ্রাতুষ্পুত্রটি সেতারে ঝঙ্কার দিল। ঝিনি ঝিনি ঝিন ঝিন ইমন কল্যাণ বাজিতে লাগিল।

 তাহার পর দিন অনুসন্ধান করিয়া অবগত হওয়া গেল, জাহাজের এটা ওটা সেটা অনেক জিনিষেরই অভাব। সেগুলি না থাকিলেও জাহাজ চলে বটে কিন্তু যাত্রীদের আবশ্যক বুঝিয়া চলে না, নিজের খেয়ালেই চলে। কলিকাতা হইতে জাহাজের সরঞ্জাম আনিবার জন্য। লোক পাঠাইতে হইল। এখন কিছু দিন এইখানেই স্থিতি।

 গঙ্গার মাঝে মাঝে এক-এক বার না দাঁড়াইলে গঙ্গার মাধুরী তেমন উপভোগ করা যায় না। কারণ, নদীর একটি প্রধান সৌন্দর্য্য গতির সৌন্দর্য্য। চারিদিকে মধুর চঞ্চলতা, জোয়ার ভাঁটার আনাগোনা,