পাতা:বিচিত্র প্রবন্ধ-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৬
বিচিত্র প্রবন্ধ

তরঙ্গের উত্থান পতন, জলের উপর ছায়ালোকের উৎসব—গঙ্গার মাঝখানে একবার স্থির হইয়া না দাঁড়াইলে এ সব ভালো করিয়া দেখা যায় না। আর জাহাজের হাঁস-ফাঁসানি, আগুনের তাপ, খালাসীদের গোলমাল, মায়াবদ্ধ দানবের মতো দীপ্তনে এঞ্জিনের গোঁ-ভরে সনিশ্বাস খাটুনি, দুই পাশে অবিশ্রাম আবর্ত্তিত দুই সহস্রবাহু চাকার সরোষ ফেন-উদগার এ-সকল, গঙ্গার প্রতি অত্যন্ত অত্যাচার বলিয়া বোধ হয়। তাহা ছাড়া গঙ্গার সৌন্দর্য্য উপেক্ষা করিয়া ছুটিয়া চলা কার্য্যতৎপর অতিসভ্য উনবিংশ শতাব্দীকেই শোভা পায় কিন্তু রসজ্ঞের ইহা সহ্য হয় না। এ যেন আপিসে যাইবার সময় নাকে মুখে ভাত গোঁজা। অন্নের অপমান। যেন গঙ্গা-যাত্রার একটা সংক্ষিপ্ত সংস্করণ গড়িয়া ভোলা। এ যেন মহাভারতের সূচিপত্র গলাধঃকরণ করা।

 আমাদের জাহাজ লৌহশৃঙ্খল গলায় বাঁধিয়া পাড়া দাঁড়াইয়া রহিল। স্রোতস্বিনী খর-প্রবাহে ভাসিয়া চলিয়াছে। কখনো তরঙ্গসঙ্কুল, কখনো শান্ত, কোথাও সঙ্কীর্ণ, কোথাও প্রশস্ত, কোথাও ভাঙন ধরিয়াছে, কোথাও চড়া পড়িয়াছে। এক-এক জায়গায় কূল কিনারা দেখা যায় না। আমাদের সম্মুখে পরপার মেঘের রেখার মতো দেখা যাইতেছে। চারিদিকে জেলেডিঙি ও পালতোলা নৌকা। বড়ো বড়ো জাহাজ প্রাচীন পৃথিবীর বৃহদাকার সরীসৃপ জলজন্তুর মতে ভাসিয়া চলিয়াছে। এখন বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। মেয়েরা গঙ্গার জলে গা ধুইতে আসিয়াছে, রোদ্‌ পড়িয়া আসিতেছে। বাঁশ বন, খেজুর বন, আম বাগান ও ঝোপঝাপের ভিতরে ভিতরে এক একটি গ্রাম দেখা যাইতেছে। ডাঙায় একটা বাছুর আড়ি করিয়া গ্রীবা ও লাঙ্গুল নানা ভঙ্গীতে অস্ফালন পূর্ব্বক একটিবড়ো ষ্টীমারের সঙ্গে সঙ্গে ছুটিয়াছে। গুটিকতক মানব-সন্তান ডাঙায় দাঁড়াইয়া হাততালি দিতেছেন; যে চর্ম্মখানি পরিয়া পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, তাহার বেশি পোষাক পরা আবশ্যক বিবেচনা করেন নাই। ক্রমে অন্ধকার