পূর্ববঙ্গের প্রভাব
সেকালে যখন সাধুভাষাই সাহিত্যের একমাত্র বাহন ছিল তখন সুপ্রতিষ্ঠ লেখকদের রচনা পড়ে বোঝা যেত না তাঁরা কোন্ জেলার লোক। কলকাতার রমেশচন্দ্র দত্ত, ঢাকার কালীপ্রসন্ন ঘোষ, চাটগাঁয়ের নবীনচন্দ্র সেন, মহারাষ্ট্রের সখারাম গণেশ দেউস্কর একই ভাষায় লিখেছেন। তাঁদের রচনায় গ্রাম্য বা প্রাদেশিক শব্দ না থাকায় ভাষার ভেদ হ’ত না। কিন্তু আজকাল চলিতভাষায় যা লেখা হয় তা পড়লে প্রায় বোঝা যায় লেখক পূর্ববঙ্গীয় কিংবা পশ্চিমবঙ্গীয়। ‘আপ্রাণ, সাথে, কিছুটা, কেমন জানি (কেমন যেন), সুন্দর মতে’ ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গে চলে না। কিন্তু এসব প্রয়োগ অশুদ্ধ নয়, অতএব বর্জনীয় বলা যায় না। পূর্ববঙ্গবাসী অতিরিক্ত -গুলি আর -টা প্রয়োগ করেন, অকারণে ‘নাকি' লেখেন, অচেতন পদার্থেও মাঝে মাঝে -রা যোগ করেন। (‘আকাশ হতে জলেরা ঝরে পড়ছে’), কর্মকারকে অনেক সময় অনর্থক -কে বিভক্তি লাগান (‘বইগুলিকে গুছিয়ে রাখ’)। তাঁরা নিজের উচ্চারণ অনুসারে ‘দেওয়া নেওয়া সওয়া’ (১১৪) স্থানে ‘দেয়া নেয়া সোয়া’ লেখেন, মোমবাতি অর্থে ‘মোম’, টেলিগ্রাম অর্থে ‘টেলি’ লেখেন। এই সব প্রয়োগও নিষিদ্ধ করা যাবে না। বিলাত আর মার্কিন দেশের ভাষা ইংরেজী, কিন্তু অনেক নামজাদা লেখকের রচনায় ওয়েল্স স্কচ বা আইরিশ ভাষার ছাপ দেখা যায়, মার্কিন ইংরেজী অনেক সময় খাস ইংরেজের অবোধ্য ঠেকে। পূর্ববঙ্গীয় অনেক বৈশিষ্ট্য সাহিত্যিক বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হয়ে যাচ্ছে, তাতে আপত্তি করা চলবে না।
তথাপি মানতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গের মৌখিক ভাষার সঙ্গেই সাহিত্যিক চলিতভাষার সাদৃশ্য বেশী। সকল লেখকই তাঁদের প্রাদেশিক সংস্কার পরিহার করে পশ্চিমবঙ্গীয় রীতি অনুসরণের চেষ্টা