পাতা:বিচিন্তা - রাজশেখর বসু.pdf/৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিচিন্তা
২০

তেত্রিশ কোটি দেবতার পূজা করে এবং সেই সঙ্গে এক পরমাত্মাকে মানতেও যাদের বাধে না, তারা সহজেই মাঝে মাঝে পুরাতন দেবতা বর্জন এবং নূতন দেবতা গ্রহণ করতে পারে। অন্য ধর্মের প্রতি তাদের আক্রোশও থাকে না। ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণ প্রভৃতি এখন আর পূজা পান না, কিন্তু শ্রীচৈতন্য ও শ্রীরামকৃষ্ণ দেবতার আসন পেয়েছেন, ভারতমাতা ও বঙ্গমাতাও দেবতারূপে গণ্য হয়েছেন। রূপকের আশ্রয়ে জন্মভূমিকে দুর্গা কমলা ও বাণীর সঙ্গে একীভূত কল্পনা করা হিন্দুর পক্ষে সহজ, কিন্তু একেশ্বরপূজকের তা ক্রীডবিরুদ্ধ। এই কারণেই ‘বন্দেমাতরম্' অন্যতর জাতীয় সংগীতরূপে গণ্য হয় নি, লোক ভোলাবার জন্য তাকে শুধু 'সমান মর্যাদা’ দেওয়া হয়েছে। বহু আধুনিক শিক্ষিত হিন্দু বকরিদের খাসির মাংস অথবা খ্রীষ্টান ইউকারিস্ট সংস্কারে নিবেদিত রুটির টুকরো পেলে বিনা দ্বিধায় খেতে পারেন, কারণ তাঁদের দৃষ্টিতে এসকল বস্তু খাদ্য মাত্র। কিন্তু খ্রীষ্টান মুসলমান এবং গোঁড়া ব্রাহ্মর পক্ষে হিন্দু দেবতার প্রসাদ খাওয়া সহজ নয়, তাঁরা মনে করেন এপ্রকার খাদ্যে পৌত্তলিক বিষ আছে, খেলে আত্মা ব্যাধিগ্রস্ত হবে।

 মধ্যযুগে ইওরোপে দার্শনিক ও প্রাকৃতিক বিষয় সম্বন্ধে যে সকল মত প্রচলিত ছিল তার ভিত্তি বাইবেল এবং আরিস্টটল প্রভৃতি গ্রীক পণ্ডিতদের সিদ্ধান্ত। এই অদ্ভুত সমন্বয়ের বিরুদ্ধে কোনও খ্রীষ্টান কিছু বললে তার প্রাণসংশয় হত। ষোড়শ শতাব্দে ভিয়েনা নগরে সের্ভেস নামে এক শারীরবিজ্ঞানী ছিলেন। হৃৎপিণ্ডে রক্তের গতি সম্বন্ধে তিনি প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে লেখেন। তাঁর আরও গুরুতর অপরাধ—বাইবেলে জুডিয়া প্রদেশের যে বর্ণনা আছে তার প্রতিবাদে তিনি বলেন, জুডিয়ায় দুগ্ধমধুর স্রোত বয় না, এ স্থান মরুভূমির তুল্য।