পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী

অভাব দর্শনে তিনি বিমর্ষান্বিত হন ও জগতেরও এই প্রকার অবস্থা কি না জানিবার জন্য চঞ্চল হইয়া উঠেন। তাঁহার বিশাল হৃদয়, বিশালতর হইয়া ক্রমে সমগ্র জগৎ ব্যাপিয়া যায়, —কোন বিশেষ কেন্দ্রে আবদ্ধ থাকিতে পারে না। এক কথায় তিনি জগৎকে আপনার হৃদয় দিয়া ভালবাসেন, আপনার বলিতে জগৎ ভিন্ন তাঁহার অপর কিছু থাকে না।

 ভগবতী দেবীর মাতুলালয়ের গ্রামে ক্ষত্রিয়, রাজপুত, কায়স্থ, নাপিত প্রভৃতি অনেক ব্রাহ্মণেতর জাতির বাস ছিল। তাঁহার মাতুলালয়ের সন্নিকটে অনেক দরিদ্র তেওর ও বাগদী বাস করিত। ভগবতী বাল্যকালে এই সকল জাতীয় সমবয়স্কা বালিকাদিগের সহিত ক্রীড়া করিতেন। ক্রীড়ার মধ্যে তাঁহার এক বিশেষত্ব এই দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই সকল সমবয়স্কা বালিকারা তাঁহাকে ক্রীড়া করিবার জন্য আহ্বান করিলে, তিনি বলিতেন, “তোমরা সকলে আমাদের বাটীতে এস, আমরা এক সঙ্গে খেলা করিব।” এই সকল বালিকাদিগের প্রত্যেকের সহিত মকর, সই প্রভৃতি মৈত্রীবন্ধনে তিনি আবদ্ধ হইয়াছিলেন। তাঁহার কি এক আশ্চর্য্য শক্তি ছিল, তাঁহার ভালবাসার কি এক অদ্ভুত প্রগাঢ়তা ছিল যে, যে তাঁহার সংস্পর্শে আসিত তিনি তাহাকে আপনার করিয়া ফেলিতেন। এই সকল সমবয়স্কা বালিকারা তাঁহার এতদূর বাধ্য ও অনুগত হইয়াছিল যে, ক্ষণকালের জন্য তাঁহার অদর্শন তাহারা সহ্য করিতে পারিত না। তিনি তাহাদিগকে লইয়া ধূলাখেলা করিতেন না। কারণ, বালিকারা সাধারণতঃ যেরূপ ধূলাখেলা করে, সেরূপ ক্রীড়ায় তাঁহার মন ছিল না। তিনি তাহাদিগের সহিত ব্রতকথা বলিতেন, মাতামহীর নিকট যে সকল উপদেশপূর্ণ গল্প বা পৌরাণিক আখ্যায়িকা শ্রবণ করিতেন, সেই সমুদয় গল্পচ্ছলে বলিতেন। তাহাদের অভাব অভিযোগ মন দিয়া শুনিতেন এবং অভাবনিরাকরণের যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেন। তাহাদের মধ্যে কাহারও কাহারও কেশবিন্যাশ করিয়া দিতেন। এ বিষয়ে তেওর, বাগদী প্রভৃতি জাতিবিচার তাঁহার ছিল না। ঐ সকল সমবয়স্কা বালিকারা খেলা করিবার জন্য একত্র হইলে, কখন কখন তিনি তাহাদিগকে সুমিষ্ট খাদ্যদ্রব্য ভোজন করাইয়া পরম তৃপ্তিলাভ করিতেন। সময়ে সময়ে তিনি তাহাদিগের কোন অমঙ্গল সংবাদ ও দুঃখকাহিনী শ্রবণ করিয়া এরূপ আত্মহারা হইয়া পড়িতেন, তাঁহার হৃদয় এরূপ বিগলিত হইত যে, তাঁহার রক্তোৎপলনিভ গণ্ডস্থল বহিয়া প্রবলবেগে অশ্রুধারা নিপতিত হইত। সঙ্গিনীদিগের মধ্যে কেহ পীড়িতা হইলে, তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া জাতিধর্ম্মনির্ব্বিশেষে তাহার পরিচর্য্যা করিতেন। ইহাতে তিনি সুখ ও আনন্দ অনুভব করিতেন। তাঁহার এই সকল বাল্যলীলা পর্য্যালোচনা করিলে মনে হয়, তিনি শৈশবকাল হইতেই সেবাধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। শৈশবেই যেন তিনি বুঝিয়াছিলেন, এই সেবাধর্ম্মই প্রকৃত হিন্দুধর্ম্ম। মনুষ্য মাত্রেই পরমাত্মার মূর্ত্তিস্বরূপ; ব্রহ্মের বিকাশই মানুষ। এই মনুষ্যের সেবাই হিন্দুর পরম ধর্ম্ম। প্রকৃত বৈদান্তিক সমস্ত বস্তুতেই