পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পারিবারিক জীবন
৫৩

তীর্থের পথপর্য্যটনস্বরূপ, এবং তাঁহাদের পারিবারিক প্রত্যেক কার্য্য স্বর্গরাজ্যের সোপানস্বরূপ হইয়া থাকে।

 ঠাকুরদাসের ঔরসে ও ভগবতী দেবীর গর্ভে সাত পুত্র ও তিন কন্যা জন্ম গ্রহণ করেন। পুত্রগণের নাম, ঈশ্বরচন্দ্র, দীনবন্ধু, শম্ভুচন্দ্র, হরচন্দ্র, হরিশচন্দ্র, ঈশানচন্দ্র ও ভূতনাথ। তিন কন্যার নাম,—মনোমমোহিনী, দিগম্বরী ও মন্দাকিনী। আমরা যে সময়ের প্রসঙ্গ বলিতেছি, তখন ঈশ্বরচন্দ্র ও দীনবন্ধুর শুভ পরিণয় কার্য্য্য সম্পন্ন হইয়াছে। সুতরাং পুত্র, কন্যা, পুত্রবধু ও পরিবারভুক্ত আশ্রিত আত্মীয় স্বজন লইয়া ভগবতী দেবীর এক বৃহৎ সংসার। সংসারই মানুষের প্রকৃত পরীক্ষার স্থল। সংসাররূপ পরীক্ষাক্ষেত্রে ভগবতী দেবী কি ভাবে ও কি পরিমাণে কর্তব্যানুষ্ঠান করিতে পারিয়াছিলেন, নিম্নলিখিত ঘটনাবলী পাঠে পাঠকগণ তাহা হৃদয়ঙ্গম করিতে প্রয়াস পাইবেন।

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, আলস্য পারিবারিক সুখের এক অন্তরায়। আলস্য ও জড়তা যাহাতে পরিবার মধ্যে প্রবেশ লাভ করিতে না পারে, তৎপ্রতি ভগবতী দেবীদ তীক্ষ দৃষ্টি ছিল। তিনি পরিবারস্থ প্রত্যেকের কতকগুলি কার্য্য নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। পর্য্যায়ক্রমে প্রত্যেককেই সেই সকল কার্য্য প্রত্যহ সুসম্পন্ন করিতে হইত। এইরূপে একের করণীয় পরিশ্রমের ভার অপরকে বহন করিতে হইত না। সুতরাং পরিবার মধ্যে এ সম্বন্ধে মনোভঙ্গেরও কোন কারণ উপস্থিত হইত না। এই সকল পারিবারিক বিধি যাহাতে পরিবারস্থ সকলে ক্লেশকর মনে না করে, সেইজন্য তিনি স্বয়ং প্রাতঃকাল হইতে রজনীর প্রায় তৃতীয় প্রহর পর্যন্ত অক্লান্ত ভাবে পরিশ্রম করিতেন। প্রাতঃকালে শয্যাত্যাগ করিয়া প্রাতঃকৃত্য সমাপনান্তর গৃহ এবং গৃহের যাবতীয় পদার্থের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি তিনি মনোনিবেশ করিতেন। দ্রব্যের অপচয় সম্পত্তি সঞ্চয়ের বিরোধী, সকল দ্রব্য হইতেই কোন না কোন প্রয়োজন সাধিত হইতে পারে, এইজন্য তিনি অতি সামান্য দ্রব্যও সযত্নে রক্ষা করিতেন। গৃহসামগ্রীসকল বিশৃৃঙ্খল করিয়া রাখা, সম্পত্তি রক্ষা ও সম্পত্তি বৃদ্ধির প্রতিকূল। গৃহ এবং গৃহস্থিত দ্রব্যাদি শীঘ্র বিনষ্ট হইতে দিলে সত্বরই ধনক্ষয় হয়, এইজন্য তিনি সর্ব্বাগ্রে গৃহের যাবতীয় বিষয়ের শৃঙ্খলা স্থাপন করিতেন। এই সকল কার্য্যে তিনি গহের শিশু সন্তানদিগের সাহায্য গ্রহণ করিতেন। তিনি গৃহের সন্তানদিগকে শিক্ষা দিতেন, “আমি যদি গৃহে থাকি, আর কেহ কোন দ্রব্য লইতে আইসে তাহা হইলে, ‘নাই’ কথা কখন মুখে আনিও না। আমি যে পরিমাণে দিই, সে পরিমাণে না দিলেও, কিছু দিবে। শুধু হাতে তাহাদিগকে ফিরাইয়া দিবে না।” তিনি প্রত্যহ স্বয়ং রন্ধন করিতেন। এবং পরিবারস্থ সকলকে সমভাবে পরিবেশন করতেন। এ সম্বন্ধে কেহ কখন তাঁহার পার্থক্য দৃষ্টিগোচর করে নাই। পরিবারস্থ সকলের আহারাদি সুসম্পন্ন হইতে দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া যাইত। তৎপরে কোন অতিথি সমাগত হয় কি না