পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/১০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জ্ঞান ভারতবর্ষে দর্শন কাহাকে বলে ? ইহার উত্তর দিতে গেলে প্ৰথমে বুঝিতে হইবে বে, ইউরোপে যে অর্থে “ফিলসফি” শব্দ ব্যবহৃত হয়, দর্শন সে অর্থে ব্যবহৃত হয় না । বাস্তলিক ফিলসফি শব্দের অর্থের স্থিরতা নাই,-কখন ইহার অর্থ অধ্যাত্মতত্ত্ব, কখন ইহার অর্থ প্ৰাকৃতিক বিজ্ঞান, কখন ইহার অর্থ ধৰ্ম্মনীতি, কখন ইহার অর্থ বিচারবিদ্যা । ইহার একটিও দর্শনের ব্যাখ্যার অনুরূপ নহে। ফিলসফির উদ্দেশ্য, জ্ঞানবিশেষ ; তদাতিরিক্ত অন্য উদ্দেশ্য নাই । দর্শনেরও উদ্দেশ্য জ্ঞান বটে, কিন্তু সে জ্ঞানেরও উদ্দেশ্য আছে । সেই উদ্দেশ্য নিঃশ্রেয়স, মুক্তি, নির্বাণ বা তদ্বৎ নামান্তরবিশিষ্ট পারলৌকিক অবস্থা । ইউরোপীয় ফিলসফিতে জ্ঞানই সাধনীয় ; দর্শনে জ্ঞান সাধন মাত্ৰ । ইহা ভিন্ন আর একটি গুরুতর প্রভেদ আছে । ফিলসফির উদ্দেশ্য, জ্ঞানবিশেষ,-কখন আধাত্মিক, কখন ভৌতিক, কখন নৈতিক বা সামাজিক জ্ঞান। কিন্তু সৰ্ব্বত্র পদার্থ মাত্রেরই জ্ঞান দর্শনের উদ্দেশ্য । ফলতঃ সকল প্রকার জ্ঞানই দর্শনের অন্তর্গত । ংসার দুঃখময় । প্রাকৃতিক বল, সৰ্ব্বদা মনুষ্য-সুখের প্রতিদ্বন্দ্বী। তুমি যাহা কিছু সুখভোগ কর, সে বাহা প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া লাভ কর । মনুস্যজীবন, প্রকৃতির সঙ্গে দীর্ঘ সমর মাত্র-যখন তুমি সমরজয়ী হইলে, তখনই কিঞ্চিৎ সুখলাড় করিলে। কিন্তু মনুষ্যবল হইতে প্ৰাকৃতিক বল অনেক গুণে গুরুতর। অতএব মানুষ্যের জয় কদাচিৎপ্রকৃতির জয়ই প্রতিনিয়ত ঘটিকা থাকে। তবে জীবন যন্ত্রণাময়। আৰ্য্য মতে ইহার আবার পৌনঃপুন্য আছে । ইহজন্মে, অনন্ত দুঃখ কোনরূপে কাটাইয়া, প্ৰাকৃতিক রণে শেষে পরাস্ত হইয়া, যদি জীব দেহত্যাগ করিল-তথাপি ক্ষমা নাই—আবার জন্মগ্রহণ করিতে হইবে, আবার সেই অনন্ত দুঃখভোগ করিতে হইবে-আবার মরিতে হইবে,- আবার জন্মিতে হইবে,--আবার দুঃখ । এই অনন্ত দুঃখের কি নিবৃত্তি নাই ? মনুষের নিস্তার নাই ? ইহার দুই উত্তর আছে। এক উত্তর ইউরোপীয়, আর এক উত্তর ভারতবর্ষীয়। ইউরোপীয়েরা বলেন, প্রকৃতি জেয় ; যাহাতে প্ৰকৃতিকে জয় করিতে পার, সেই চেষ্টা দেখ। এই জীবন-রণে প্রকৃতিকে পরাস্ত করিবার জন্য আয়ুধ সংগ্ৰহ কর । সেই আয়ুধ, প্ৰকৃতিকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি নিজেই বলিয়া দিবেন। প্ৰাকৃতিক তত্ত্ব অধ্যয়ন করাপ্রকৃতির গুপ্ত তত্ত্ব সকল অবগত হইয়া, তাহারই বলে তাহাকে বিজিত করিয়া, মনুষ্যজীবন সুখময় কর । এই উত্তরের ফল-ইউরোপীয় বিজ্ঞানশাস্ত্ৰ । ভারতবর্ষীয় উত্তর এই যে, প্ৰকৃতি অজেয়-যন্ত দিন প্ৰকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধ থাকিবে, তত দিন দুঃখ থাকিবে । অতএব প্ৰকৃতির সঙ্গে সম্বন্ধবিচ্ছেদই দুঃখ নিবারণের একমাত্র